Sunday, June 1, 2014

গীবত বা পরনিন্দা মারাত্মক অপরাধ

গীবত বা পরনিন্দা মারাত্মক অপরাধ

গীবত এমন এক জঘন্যতম গুনাহ যা মানুষের ঈমান ও আমলকে ধ্বংস করে দেয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতকে বিনষ্ট করে দেয়।
গীবত কি ঃ এককথায় পরচর্চা, যার সর্ম্পকে কোন কথা তার পিছনে বলা হয় , সে কথা শুনলে ঐ ব্যক্তি দুঃখ পায়, তাই গিবত।
 আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন-‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেনো পরস্পরের গীবতে লিপ্ত না হও। তোমাদের কেউ কী তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমারা তা ঘৃণা করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়াশীল।’ (সূরা হুজরাত-১২)
হাদিস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-‘গীবত যিনা বা অবৈধ যৌনাচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য গুনাহ।’ (শু‘য়াবুল ঈমান-৫/৩০৬)
উপযুর্ক্ত কোরআনের আয়াত ও হাদিস শরীফ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, গীবত এমন এক জঘন্যতম গুনাহ যা মানুষের ঈমান ও আমলকে ধ্বংস করে দেয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতকে বিনষ্ট করে দেয়।


কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়,  নিজেদের অজ্ঞাতসারে আজ আমরা এ জঘন্যতম গুনাহে নিমজ্জিত।  সমাজে এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যার থেকে এ গুনাহটি প্রকাশ পায় না। এর কারণ, মূলত আমরা এটিকে এমন কোনো গুনাহই মনে করি না। এটি যে মারাত্মক গুনাহ এবং এর পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ, সে অনুভুতিটুকুও আমাদের অন্তর থেকে মুছে গেছে। যার কারণে আমরা কোনো ভাইয়ের গীবত বা নিন্দা করতে দ্বিধাবোধ করছি না।
গীবত হলো, কথায় বা ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা অন্য কোনো উপায়ে অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কোনো দোষ আলোচনা করা যা শুনলে সে মনে ব্যথা পেতে পারে, যদিও তা সত্য হয়। কেননা, মিথ্যা হলে সেটি অপবাদ বা তোহমদ, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে গীবতের চেয়েও জঘন্য।
যেমন- হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত। একবার রাসূলল্লাহ (সা.) সাহাবিদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি জানো গীবত কী? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) অধিক ভাল জানেন। রাসূল (সা.) বললেন, তোমার কোনো ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, এটিই গীবত। রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? রাসূলল্লাহ (সা.) বললেন. তুমি যা বলো তার মধ্যে তা বিদ্যমান থাকলে, তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে বিদ্যমান না থাকে, তখন তুমি তার ব্যাপারে অপবাদ রটালে।’ (মুসলিম শরীফ-২/৩২২)
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বললাম, ‘আপনাকে সাফিয়া সম্পর্কে এতোটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সে এরূপ এরূপ। হযরত আয়েশা (রাযি.) এর দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন, সাফিয়া একটু বেঁটে। এ কথা শুনে, রাসূল (সা.) বললেন, তোমার এ কথাকে যদি সমুদ্রের সাথে মিশ্রিত করে দেয়া হয়, তবে তা সমুদ্রের রং পরিবর্তন করে দিবে।’ (আবু দাউদ-২/৬৬৮)
রাসূলু
ল্লাহ (সা.) এর স্ত্রীদের মধ্যে হযরত সাফিয়া (রাযি.) একটু বেঁটে ছিলেন। এ কথাটি রাসূল (সা.) এর সামনে প্রকাশ করাও গীবত বলে অভিহিত করেছেন। এ হাদিসে গীবতের গুনাহর পরিমাণকে সমুদ্রের পানির রং পরিবর্তনের সাথে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। এ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, গীবত কত নিকৃষ্টতম গুনাহ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যের দোষ প্রকাশ তো দূরের কথা; বরং তা তালাশ করার থেকে বিরত থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, হে মানব সকল! যারা শুধুমাত্র মুখে ঈমান এনেছো, ঈমান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহপাক তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহপাক যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করেন। (আবু দাউদ- ২/৬৬৯)
এছাড়া অনেক হাদিসে গীবতের ভয়াবহ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন-হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) বলেন, আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে এমন দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যে দু’টি কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসূল (সা.) বললেন, এদেরকে বড় কোনো গুনাহের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না। তাদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে, তাদের একজন মানুষ গীবত করতো এবং অপরজন পেশাব থেকে পরহেজ করতো না। (আদাবুল মুফরাদ-১/২৫৬)
অন্যত্রে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ করে, দুর্গন্ধময় মৃত ব্যক্তির ঘ্রাণ ছড়ালো। রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা কি জানো এটি কিসের দুর্গন্ধ? রাসূল (সা.) বললেন, এটি ওই সমস্ত ব্যক্তির দুর্গন্ধ, যারা দুনিয়াতে মানুষের গীবত করতো।’ (মুসনাদে আহমদ- ৩/৩৫১)
হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন আমাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, সেখানে আমি এমন কিছু মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিলো তামার। তারা তাদের চেহারা এবং বক্ষকে আঁচড়াতে ছিলো। আমি জিবরাঈল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাঈল (আ.) বললেন, এরা ওই সমস্ত ব্যক্তি, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশতো ভক্ষণ করতো, অর্থাৎ, তারা মানুষের গীবত করতো এবং তাদের ইজ্জতহানি করতো।’ (আবু দাঊদ-২/৬৬৭)
উপর্যুক্ত কয়েকটি হাদিস দ্বারা এ কথা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, গীবত মারাত্মক গুনাহ এবং গীবতকারীদের আখিরাতে আল্লাহপাকের ভয়ানক শাস্তি অবধারিত।
গীবত এতো নিকৃষ্ট যে, গীবতের কারণে নামাজ-রোজার সওয়াব পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে অনেক সময় রাসূলল্লাহ (সা.) কেউ অন্যের গীবত করে থাকলে, তাদের নামাজ-রোজা পুনরায় আদায় করার জন্যে আদেশ দিতেন।
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। একবার দু’জন ব্যক্তি যোহর অথবা আসরের নামাজ আদায় করলো। তারা উভয়ই ছিলো রোজাদার। রাসূল (সা.) নামাজ সমাপ্ত করে উক্ত দু’জন ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা উভয়ই পুনরায় ওজু করো এবং নামাজ আদায় করো। (আজকের ) রোজা পূর্ণ করে অন্য কোনো দিন এর কাযা করো। তারা জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.) কেন? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা অমুক ব্যক্তির গীবত করেছো। (শু‘য়াবুল ঈমান-৫/৩০৩)
গীবতের সম্পৃক্ততা বান্দার হকের সাথে এবং দুনিয়াতে এর কোনো শাস্তির বিধান নেই। বান্দা মাফ না করলে কখনো গীবতের গুনাহ মুছন হবে না। তাই হাদিস শরীফে গীবতের গুনাহকে অন্যান্য গুনাহর থেকে জঘন্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন- হযরত আবু সাঈদ ও জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, গীবত যিনা ব্যাভিচার থেকেও জঘন্য। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) কিভাবে গীবত যিনা ব্যাভিচার থেকেও জঘন্য? রাসূল (সা.) বললেন, কোনো ব্যক্তি যিনা করে, অতঃপর সে তওবা করে, ফলে আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহপাক ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত যার গীবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে। হযরত আনাস (রাযি.)-এর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যিনাকারী তওবা করে, কিন্তু গীবতকারীর তওবা নেই। (শু‘য়াবুল ঈমান-৫/৩০৬)
যে মজলিসে গীবত বা পরনিন্দার আলোচনা হয়, সেখানে নিশ্চুপ হয়ে গীবত শ্রবণ করাও গীবতের সমুতল্য অপরাধ।
হাদিস শরীফে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন তোমার উপস্থিতিতে  কারো গীবত করা হয়, তখন তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দাও এবং তার ভাল দিকগুলো তুলে ধরো, সম্ভব হলে গীবত বন্ধ করার চেষ্টা করো, অন্যথায় সে মজলিস বর্জন করো। কেননা, চুপ থাকলে তুমিও গীবতকারী বলে গণ্য হবে।’ (দুররে মানছুর)
গীবতের গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার পন্থা হচ্ছে, যার গীবত করা হয়েছে, সে জীবিত থাকলে সরাসরি তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। আর সে মারা গেলে তার জন্য ইসতেগফার করাই ক্ষমা পাওয়ার একমাত্র উপায়। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, রাসূলল্লাহ (সা.) বলেছেন, গীবতের কাফফারা হলো, যার গীবত করা হয়েছে, তার জন্য মাগফিরাত কামনা করা। (মেশকাত-২/৪১৫)
সূত্র - মূফতি  শামসুর রহমান পোরশা, দৈনিক ইনকিলাব।

0 comments:

Post a Comment