Thursday, September 10, 2015

মাতৃভক্ত পুত্রের বিরল সততার কথা কোরআনে বর্ণিত গাভী জবাই প্রথা

মাতৃভক্ত পুত্রের বিরল সততার কথা 

কোরআনে বর্ণিত গাভী জবাই প্রথা

হজরত মুসা (আ.)-এর জ্বালাতনকারী হঠকারী কওম বনি ইসরাইলের অপকর্মের বিবরণ  কোরআনের অসংখ্য স্থানে বিবৃত হয়েছে। গরুকে কেন্দ্র করে তারা যে তেলেসমাতি কা-কারখানা ঘটিয়েছিল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গরুর নামে সূরা বাকারা নামকরণ করা। একটি বেহুদা বিষয় হজরত মুসা (আ.)-কে আল্লাহর দরবারে বারবার জিজ্ঞাসা করতে প্রেরণ করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, বনি ইসরাইল কত বড় বেয়াড়া ও কুতার্কিক জাতি ছিল। এহেন আচরণের খেসারতও তাদের দিতে হয়েছে সুদীর্ঘ ৪০ বছর। তাদের বোকামি ও অপরিণামদর্শিতার প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের একটি গরু জবাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র, তারা একটি যে কোনো প্রকারের গরু জবাই করলেই যথেষ্ট ছিল। হুজুর (সা.)-এর এ ছোট্ট বক্তব্যে বিরাট শিক্ষা নিহিত রয়েছে, আর তা হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় ও বেহুদা কথা বললে তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হতে পারে, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বনি ইসরাইলের গরুর ঘটনা। সূরা বাকারার ৬৭ হতে ৭৩নং আয়াত পর্যন্ত গরুর কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। কোরআনসহ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত কাহিনীটি এরূপ:বনি ইসরাইলে আমিল নামক এক ধনী ব্যক্তি ছিল। তার এক ভাতিজা ব্যতীত আর কোনো ওয়ারিশ ছিল না। চাচার মৃত্যুতে বিলম্ব দেখে ওয়ারেশি সম্পদের লোভে ভাতিজা তার চাচাকে হত্যা করে এবং তার লাশ নিয়ে অন্য গ্রামে ফেলে আসে স্থানীয় লোকেরা তার লাশ দাফন করে। ঘটনাটি ছিল রাতের। পরের দিন ভাতিজা চাচার খুনের দাবিদার হয় এবং মহল্লার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং তার চাচার খুনের দাবি পেশ করে। হজরত মুসা (আ.) লোকদের নিকট নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, সবাই অস্বীকার করে। তাই নিহত ব্যক্তির ব্যাপারটি হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ে। লোকেরা হজরত মুসা (আ.)-কে অনুরোধ জানায়, তিনি যেন আল্লাহর দরবারে নিহত ব্যক্তির অবস্থা প্রকাশের জন্য দোয়া করেন। তিনি দোয়া করেন এবং আল্লাহর দরবার  হতে নির্দেশ আসে একটি গরু জবাই করার। বনি ইসরাইল সহজ-সরলভাবে নির্দেশ পালন না করে বারবার নানা প্রশ্ন করে জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে এবং আল্লাহর দরবার হতেও কঠিন শর্ত আরোপ করা হতে থাকে, যার বিবরণ কোরআনে রয়েছে। তবে কিভাবে আল্লাহর নির্দেশিত গরুর সন্ধান লাভ করে তার উল্লেখ না থাকলেও তারা ইনশাল্লাহ বলেছিল বলে তারা সেই গরু পেয়েছিল এবং তা জবাই করে গরুর অংশ বিশেষ নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করলে সে জীবিত হয়ে বলে দিয়েছিল, তার ভাতিজাই তার হত্যাকারী। হত্যাকারীর কি শাস্তি হয়েছিল কোরআনে তার উল্লেখ নেই। তবে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তওরাতে মিরাসের বিধান অবতীর্ণ হয় বলে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।ইনশাল্লাহ বলার ফলে আদিষ্ট গরু পাওয়া যায় বলেও বর্ণনা রয়েছে। এ কথার তৎপর্য কি? আল্লাহ চাইলে এ বাক্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা উচ্চারণ করেনি আদিষ্ট গরুর সন্ধান তারা পায়নি। এ কথা বলার পরই তারা গরুর খোঁজ পায়। ইনশাল্লাহর মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ধারণা নিহিত রয়েছে। এ বাক্য উচ্চারণ করার ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় কাজ সমাধা হয়ে যাওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই যে কোনো ভালো কাজ করার পূর্বে আল্লাহর ওপর ভরসা করা অর্থাৎ ইনশাল্লাহ বলে আরম্ভ করা উচিত। বনি ইসরাইলের এ ঘটনায় তার শিক্ষা রয়েছে। হত্যাকারী শনাক্তকরণে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী গরু সন্ধানের ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে একটি বর্ণনা নি¤œরূপ :বনি ইসরাইলে একজন ছালেহ বা সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তার এক পুত্র ও একটি গরু বাছুর ছিল। একদিন তিনি গরুর বাছুরটি জঙ্গলে নিয়ে যান এবং আল্লাহর দরবারে এই মর্মে প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! এ বাছুরটি তোমার সফরদ করছি যাতে আমার ছেলে বড় হলে এটি তার কাজে আসে। বাছুরটি জঙ্গলে ছেড়ে আসার কিছুদিনের মধ্যে লোকটির মৃত্যু ঘটে এবং বাছুরটি জঙ্গলে যৌবনে পৌঁছে। বাছুরটির অবস্থা ছিল এই যে, কোনো লোক যদি তার কাছে আসার চেষ্টা করত তাকে দেখামাত্র সে দূরে পালিয়ে যেত।মায়ের অত্যন্ত ভক্ত, অনুগত ও খেদমতগুজার ছেলেটিও বড় হয় এবং যৌবনে পৌঁছে। তার অবস্থা ছিল এই যে, রাতের অংশকে সে তিন ভাগে ভাগ করত, এক ভাগ তার মায়ের সেবাযতেœ কাটাতো, এক ভাগ আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো এবং নিজের আরামে ব্যয় করতো। ভোরে উঠে সে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ বা লাকড়ি সংগ্রহ করতো এবং বাজারে নিয়ে গিয়ে তা বিক্রি করতো। বিক্রিলব্ধ অর্থও সে তিন ভাগে ভাগ করতো। এক অংশ দান-সদকা করতো, এক অংশ নিজের খাবারে ব্যয় করতো এবং এক অংশ তার মাকে প্রদান করতো। ছেলেটির মা একদিন তাকে বলল, তোমার পিতা মিরাহ বা উত্তরাধিকার হিসেবে একটি গরুর বাছুর রেখে যান এবং ওটা আল্লাহর নামে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, তুমি সেখানে যাও এবং হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.), হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর নিকট দোয়া করো যেন তিনি ঐ বাছুরকে তোমার সমর্পণ করেন। বাছুরটির পরিচয় হচ্ছে, তুমি যখন তাকে দেখবে তখন তার চামড়া হতে সূর্যের উল্কার ন্যায় আলোক নির্গত হচ্ছে মনে হবে। তার অপূর্ব সৌন্দর্য ও হলদে বর্ণের কারণে সে সোনালি হয়ে গেছে। ছেলেটি তার মায়ের কথা মতো জঙ্গলে গিয়ে বাছুরটিকে দেখতে পায়। সে চিৎকার করে বলল, হে গাভী! হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.),  হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর দোহাই দিয়ে আমি তোকে বলছি, তুই আমার নিকট চলে আয়। এ কথা শোনামাত্র গাভী দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ছেলেটি তার গর্দানে হাত দিয়ে হাকাতে হাকাতে তার গৃহের দিকে চলতে থাকে। আল্লাহর নির্দেশে গাভী বাকশক্তির অধিকারী হয়ে বলে ওঠে, তুমি আমার পিঠে সোয়ার হয়ে যাও, এতে তোমার আরাম হবে, যাত্রা সহজ হবে। ছেলে বলল, আমি এরূপ করবো না। কেননা, আমার মা আমাকে সোয়ার হওয়ার জন্য বলেননি বরং বলেছেন যে, তার ঘাড় ধরে নিয়ে যেতে।  গাভী বলল, ভালোই হলো, তুমি আমার ওপর সোয়ার হলে না। এরূপ হলে আমি কিছুতেই তোমার নিয়ন্ত্রণে আসতাম না। আর তোমার মায়ের সেবা-তাঁবেদারির কারণে তোমার মধ্যে এমন শানমর্যাদার সৃষ্টি হয়েছে যে, তুমি যদি পর্বকে নির্দেশ করো, মূল থেকে ওপড়ে তোমার সাথে আসতে, তাহলে সে তাই করবে।মায়ের প্রতি আনুগত্য, সেবার প্রতি পশুর জবানবন্দি প্রমাণ করে যে, সন্তানের কাছে মায়ের স্থান কত ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। তাই ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল-জান্নাতু তাহতা আকদামিন ওমমাহাতা অর্থাৎ মায়েদের পদতলে বেহেশত। মায়েদের প্রতি তথা জননীকুলের প্রতি ইসলামপূর্ব বর্বর জাহেলী যুগে কি নির্যাতনমূলক আচার-আচরণ ও দুর্ব্যবহার করা হতো তার লোমহর্ষক বিবরণ অজানা নেই কারো তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তাকে উচ্চমর্যাদায় আসীন করেছে। গাভীকে বাকশক্তি দান করে আল্লাহতায়ালা তার মুখ দিয়ে মায়ের মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাকশক্তির অধিকারী, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে।ছেলেটির কথায় ফিরে আসা যাক। ছেলেটি যখন গাভীটি নিয়ে তার মায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, তখন তার মা বলল, বেটা, তুমি দরিদ্র। তোমার কাছে টাকা-পয়সা ও অর্থ নেই। সারারাত জাগ্রত থাকা এবং দিনে কাঠ সংগ্রহ করা তোমার পক্ষে খুব কষ্টকর কাজ। তাই তুমি এ গাভী বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দাও। ছেলে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো, কত হলে বিক্রি করবো। মা বললো, তিন দিনারে বিক্রি করবে, তবে বিক্রি করার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমার পরামর্শ ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। তখনকার মূল্য অনুযায়ী গাভীটির মূল্য ছিল তিন দিনার। ছেলে গাভীটি বাজারে নিয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়ালা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন সৃষ্টির প্রতি তার অসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে এবং এ ছেলের পরীক্ষার জন্য। সে তার মায়ের অনুগত্য কতটুকু করে তা দেখাও আল্লাহর ইচ্ছা। ফেরেশতা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাভীটি কত দামে বিক্রি করবে? জবাবে সে বলল, তিন দিনার দামে বিক্রি করবে। তবে শর্ত হলো আমার মা যদি তাতে রাজি থাকেন। ফেরেশতা বললেন, আমি এর মূল্য তোমাকে ছয় দিনার দেব। শর্ত হলো, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করতে পারবে না। ছেলে জবাবে বলল, তুমি যদি গাভীর শরীরের লোম পরিমাণও আমাকে তার মূল্য দিতে চাও আমি তা গ্রহণ করবো না, যতক্ষণ না আমার মায়ের সাথে পরামর্শ করবো। তার অনুমতি ছাড়া গাভী আমি বিক্রি করবো না। অতঃপর ছেলে তার মায়ের কাছে গিয়ে জানায়, এক ব্যক্তি গাভীটির মূল্য ছয় দিনার দিতে চায়। মা বলল, আমার অনুমতিসহ ছয় দিনারে বিক্রি করে দাও। ছেলে গাভীটি নিয়ে আবার বাজারে যায়। ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করেছ? ছেলে বলল, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করেছি, মা বলেছেন যে, আমার অনুমতি ছাড়া ছয় দিনারের কমে বিক্রি করবে না। ফেরেশতা বললেন, আচ্ছা আমি তোমাকে এর মূল্য বারো দিনার প্রদান করবো। শর্ত হচ্ছে তোমার মায়ের অনুমতি নিতে পারবে না। ছেলে বলল, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এ কথা বলে সে গাভীটি নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তার মাকে অবস্থা বর্ণনা করে।ছেলের বিবরণ শুনে মা বলল, বেটা! সম্ভবত লোকটি মানুষের আকারে কোনো ফেরেশতা হবে এবং তোমার পরীক্ষা করতে চাইছে যে, তুমি মায়ের আনুগত্যে কতটুকু অটল আছ। এবার যদি সে তোমার কাছে আসে তাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, আমাদের গাভীটি আমাদের বিক্রি করতে দেবে, নাকি দেবে না। সুতরাং ছেলে যায় এবং অনুরূপ বলে। এবার ফেরেশতা ছেলেকে বললেন যে, তোমার মাকে গিয়ে বলে দাও যে, গাভীটি এখন বেঁধে রাখতে এবং বিক্রি করার ইচ্ছা হতে আপাতত বিরত থাকতে। কেননা, হযরত মুসা (আ.)-কে একজন নিহত ব্যক্তির ব্যাপারে একটি গাভীর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তিনি এ গাভী খরিদ করবেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ গাভীর লোম (কেশ) পরিমাণ সোনা দেবেন না গাভীটি বিক্রি করবে না। তাই ফেরেশতার পরামর্শ অনুযায়ী তারা গাভীটি বেঁধে রাখে।আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এবং মায়ের প্রতি ছেলের আনুগত্যের প্রতিদান হিসেবে অবিকল অনুরূপ গাভী জবাই করার জন্য নির্ধারণ করেন। সুতরাং বনি ইসরাইলকে যখন গাভী জবাই করার নির্দেশ প্রদান করা হয় তখন তারা বারবার তার গুণাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। তাই তাদের জন্য অবিকল ঐ গাভী নির্ধারিত হয়।অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, বনি ইসরাইলে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। তার একটি গো বাছুর ছিল। সে তা জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং বলে, হে আল্লাহ! আমার ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি এ বাছুর তোমার হেফাজতে দিচ্ছি। সুতরাং ছেলে বড় হয়, সে ছিল মায়ের অত্যন্ত অনুগত। গো বাছুরটিও জঙ্গলে বড় হয় এবং গাভী বয়সের হয়ে যায়। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, সুন্দর ও মোটাতাজা। বনি ইসরাইল ঐ এতিম ছেলে ও তার মায়ের কাছ থেকে তা সওদা করে এবং তার চামড়া সমান সোনা প্রদান করে। তখন ঐ গাভীর মূল্য তিন দিনার। উল্লেখ্য, বনি ইসরাইল ৪০ বছর পর্যন্ত এ গাভীর সন্ধানে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল এবং বহু চেষ্টা-তদবিরের পর এ আদিষ্ট গাভীর সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। গাভী সম্পর্কে তাদের নানা অবান্তর ও বেহুদা প্রশ্নের জবাবও আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে যায়। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন : বনি ইসরাইল যদি নির্দেশ পাওয়ামাত্র যে কোনো একটি গাভী জবেহ করে দিতো তা যথেষ্ট হতো, কিন্তু তারা কঠোরতা অবলম্বন করায় আল্লাহতায়ালাও তাদের বিষয়টি কঠিন করে দেন এবং ইসতিকমা করা নাহুসাত বা অশুভ।ইসতিকমা-এর আভিধানিক অর্থ দূরত্ব সৃষ্টি করা, দূরে চলে যাওয়া ইত্যাদি পারিভাষিক অর্থে কোনো সহজ বিষয়কে জটিল করা, কঠিন করা। এরূপ করাকে রাসূলুল্লাহ নাহুসাত বা অশুভ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন বনি ইসরাইলকে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল যে, হত্যাকারী শনাক্ত করতে হলে যে কোনো প্রকারের এক গাভী জবাই করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু প্রকারান্তরে বনি ইসরাইল এ খোদায়ী নির্দেশ অমান্য করে নতুন নতুন প্রশ্ন করতে থাকে যা তাদের পক্ষে উচিত ছিল না। ফলে আল্লাহও বিষয়টি কঠিন করেছেন, এ জটিলতা তারা ডেকে এনেছিল। 

আলোচ্য ইসতিকমা কি তা সহজে অনুধাবন করার জন্য উদাহরণ স্বরূপ হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজের (রা.) একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার খলিফা দ্বিতীয় উমর তার একজন গভর্নরকে লিখলেন যে, আমি যখন তোমাকে নির্দেশ করবো যে, একটি বকরি দান করে দাও, তখন তুমি জিজ্ঞাসা করবে ‘যান’ অথবা মায দান করব? আমি যদি তাও বলে দেই, তখন তুমি প্রশ্ন করবে পুরুষ না মাদী? আমি যদি তাও বলে দেই তখন তুমি জানতে চাইবে কালো বকরি দান করবো, নাকি সাদা? সুতরাং আমি যখন কোনো বিষয়ের নির্দেশ দান করব তার পুনরাবৃত্তি করবে না।অপর একজন খলিফার ঘটনাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি একজন শাসককে লিখলেন যে, অমুক সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে তাদের বৃক্ষগুলো কর্তন করে ফেলো এবং তাদের বাড়িঘরসমূহ ধ্বংস করে দাও। তখন শাসক লিখলেন, ঘরবাড়ি ও বৃক্ষগুলোর মধ্যে কোন কাজটি প্রথমে করব? খলিফা জবাবে জানালেন, আমি যদি তোমাকে নির্দেশ দান করি যে, বৃক্ষগুলো হতে কাজের সূচনা কর তা হলে তুমি জিজ্ঞাসা করবে কোন প্রকারের বৃক্ষগুলো হতে কাজের সূচনা করব?গাভীটির রঙ-বর্ণ কি ছিল সে সম্পর্কে বর্ণনাকারী উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গাভীটির রঙ ছিল গভীর গাঢ় হলদে। হযরত কাতাদা (রা.)-এর মতে তা ছাফ, স্বচ্ছ, পরিষ্কার রঙের ছিল এবং হযরত ইমাম হাসান বসরী (রহ.)-এর মত অনুসারে গাভীটি হলদে ঈষৎ কালো রঙ বিশিষ্ট ছিল। তবে প্রথমোক্ত মত অধিক সঠিক বলে গণ্য করা, যা কোরআনে বর্ণিত রঙের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।লোকেরা যখন গাভীটি জবাই করে তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ আসে, জবাইকৃত গাভীর একটি অংশ দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করতে। এ অংশ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও সকল ভাষ্যকারের মতে, সে অংশটি হাঁড় যা নরম হাঁড় নামে পরিচিত। যেমন নাক, কান ইত্যাদি, মোজাহেদ এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের প্রমুখের মতে, ঐ অংশটি ছিল লেজের মূল। কেননা সর্বপ্রথম লেজের মূলকে সৃষ্টি করা হয়। জেহাক বলেন, অংশটি জবান বা জিব। কেননা এটিই হচ্ছে বাকযন্ত্র। আকরানা ও কালবী বলেন, ডান রান দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, কোনো নির্দিষ্ট অংশ ছিল না, লোকেরা জবাইকৃত গাভীর গোশত দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করা মাত্র নিহত ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে যায় এবং বলে দেয় যে, অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এতটুকু বলার পর সে মৃত হয়ে পড়ে যায়। সুতরাং তার হত্যাকারী কে তা জানা হয়ে যায়, বলা হয়ে থাকে, এ ঘটনার পর কোনো হত্যাকারী মিরাসের অধিকারী হয়নি। গো পূজারীদের প্রতি এ নির্দেশ কেন?বনি ইসরাইল ছিল গোপূজারী, গোভক্ত। হজরত মুসা (আ.) যখন তার ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে তুর পর্বতে গমন করেন তখন সামেরী একটি গোবাছুর বানিয়ে তার পূজা করার জন্য বনি ইসলাইলকে প্ররোচিত করেছিল। বলা হয়ে থাকে, তখন থেকে এ জাতি গোপূজার অনুসারী ও গোভক্ত হয়ে পড়ে এবং বিশেষভাবে গাভীর হত্যাকে ওরা পাপ মনে করতে থাকে। বনি ইসলাইলের গোপ্রীতি, ভক্তি ও গোপূজার বর্ণনা তাদের তওরাত গ্রন্থেও দেখা যায়। সুরা বাকারায় বর্ণিত বনি ইসরাইলের নিহত ব্যক্তি আমিলের ঘটনা সম্পর্কে হত্যাকারী শনাক্ত করার ব্যাপারে গরু জবাইয়ের নির্দেশ ব্যাপক আলোচিত বিষয়। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদির বর্ণনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার বিখ্যাত তফসীরে মাজেদীতে তিনি লিখেছেন : (অনুবাদ : এটি ছিল সেই সময় যখন দীর্ঘকাল মিশরে ও মিশরবাসীদের মাঝে অবস্থানের কারণে তাওহীদের পতাকাবাহী ইসরাইলীদের মধ্যেও অনেক অংশবাদী রীতি-প্রথার প্রসার ঘটেছিল এবং গরুর মাহাত্ম্য ও তার পবিত্র হওয়ার ধ্যান-ধারণা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ভারতের ন্যায় মিশরেও গোমাহাত্ম্য পৌত্তলিক (অংশীবাদী) ধর্মের অংশ বিশেষ ছিল। তাওরাতে ইহুদিদের প্রতি বিভিন্ন শর্ত ও বন্ধনযুক্ত গরু জবাইয়ের আদেশ বারবার প্রদান করা হয়েছে। যথা ইসরাইল সন্তানগণকে বলে, তারা নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক জোয়াল বহন করে নাই এমন এক রক্তবর্ণা গাভী তোমার নিকট আনুক। পরে তোমরা ইলীয়াসার (আল-যাসার) যাযককে সে গাভী দেবে এবং সে তাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে এবং তার সম্মুখে তাকে হনন করা হবে। গণনা পুস্তক (১৯:২, ৩)।যে নগরে নিহত লোকদের নিকটস্থ হবে, তথাকার পাল হতে এমন একটি গো-বৎসা নেবে যা দ্বারা কোনো কার্য হয়নি। যে জোয়াল বহন করেনি। পরে সেই গো-বৎসাকে এমন একটি উপত্যকায় আনবে, যেখানে (জল¯্রােত নিত্য বয়ে যায় এবং) চাষ বা বীজবপন করা হয় না, সে উপত্যকায় তার গ্রীবা ভেঙে ফেলবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২১:৩, ৪) (তফসীরে মাজেদি পৃ. ১৩২)।তওরাতের উদ্ধৃত বিবরণ প্রমাণ করে যে, ইহুদীরা গো-পূজা করত এবং নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী শনাক্ত করতে হলেও পরে বর্ণিত গুণাবলীর একটি গাভী হত্যা করত তাদের জাহেলী আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারায় বর্ণিত নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী শনাক্ত করার জন্য গাভী জবাই করার নির্দেশ প্রদান করেন যার গুণাবলীর কথা আয়াতগুলোতেই রয়েছে।ঘটনাটি কার সম্পর্ক অধিকাংশের মতে, বনি ইসরাইলের ধনী ব্যক্তি আমিল নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও রয়েছে। আমরা আমিলের ঘটনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। তবে ভিন্ন মতগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তির এক অতি সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তার কোনো আত্মীয় মহিলার প্রতি আকৃষ্ট ছিল এবং তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিল। এ কারণে সে তার স্বামীকে হত্যা করে। হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকার কারণে গাভী জবাই করার নির্দেশ আসে। সকল আহরে ইসলামের মতে, নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয়। কেউ কেউ বলেন, হত্যাকারী ভীত হয়ে তার অপরাধ স্বীকার। অর্থাৎ হত্যার আত্মস্বীকারোক্তি করে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে আরেকটি মত হচ্ছে, বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির কন্যা বিয়ে করার প্রস্তাব পেশ করলে কন্যার পিতা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। এতে প্রস্তাবকারী ক্ষিপ্ত হয়ে কন্যার পিতাকে হত্যা করে। বাকি ঘটনার বিবরণ পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে ।এসব ঘটনার মধ্যে কোনোটি সঠিক তা আল্লাহই ভালো জানেন। কোরআনে বনি ইসরাইলের অহেতুক-বেহুদা নানা প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ গাভী কোন বর্ণ ও গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, এ গাভীর সন্ধান পেতে তাদের চল্লিশটি বছর দারুণ হয়রানির মধ্যে থাকার পর সে গাভী অতি চড়া দামে মেলে এবং তা জবাই করে তার অংশবিশেষ দিয়ে নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করার সাথে সাথে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয় এবং আবার মৃত্যুবরণ করে।কোরআনের এ বিখ্যাত ঘটনার কারণে বলা হয়ে থাকে যে, সূরাটির নাম করা হয়েছে বাকারা; শব্দটির অর্থ হচ্ছে গাভী। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু গুরুত্বপূর্ণ মাসালার উদ্ভব হয়েছে। ফেকা শাস্ত্রের পরিভাষায় এরূপ ঘটনাকে আল কাসামাহ বলা হয়। যার অর্থ হচ্ছে, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকলে, তার নাম-পরিচয় জানা না গেলে ইসলামের এ সম্পর্কে কি বিধান ও বিষয়টি নিয়ে ফেকার কিতাবগুলোতে বিশদ বিবরণ রয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত এই যে, অকুস্থলের আশপাশের তথা মহল্লাবাসীর সকলকে শপথ করে বলতে হবে যে, নিহতের হত্যাকারী সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। এরূপ খুনের ঘটনার ন্যায় গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনারও একই হুকুম বা বিধান। খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব না হলে সকল অভিযুক্তের কাছ থেকে শপথ নিতে হবে বলেও মত রয়েছে।সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট ভাষ্য ও অন্যান্য গ্রন্থের বিবরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছি। এসব গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ আরো বহু সূ² বিষয় জানা যায় বনি ইসরাইলের গাভী জবাই সংক্রান্ত তরিকা বা প্রথার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে যারা নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন মওলানা মোহাম্মদ হিফজুর রহমান সাহওয়ারভী (রা.) তা মানতে রাজি নন, তিনি এ মতকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে হাফেজ ইমাজদ্দীন ইবনে কামীরকে উদ্বুদ্ধ করে বলেন এবং ওবায়দা, আবুল আলিয়া এবং অন্যদের বর্ণিত ধারা বিবরণীগুলো পরস্পরবিরোধী এবং ছাফ সোজা কথা হচ্ছে এই যে, বনি ইসরাইলের গ্রন্থাবলী হতে গৃহীত এসব বর্ণনাকে স্বীকারও করি না, মিথ্যাও বলি নাÑ যা নকল করা জায়েজ বটে। এ কারণে ওসব বর্ণনার ওপর নিশ্চিতরূপে আস্থাশীল হওয়া যায় না তবে সে সব বর্ণনা কোরআন ও হাদীসের আলোকে অধিক সঠিক, সত্য, সেগুলো আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। তিনি আরো বলেন, যখন মুসলিমের হাদীসে মাত্র এতটুকু উল্লেখ আছে যে, বনি ইসরাইল যদি মুসা (আ.)-এর সাথে বাদানুবাদ না করত, তাহলে গাভীর ব্যাপারে তাদের প্রতি শর্তাবলী আরোপিত হতো না, তাহলে যদি এর চেয়ে অধিক অবস্থা ও ঘটনাবলিও তার সাথে সম্পৃক্ত হতো, তাহলে নবী মাসুম (স.) অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। (কাসাসুল কোরআন প্রথম খ. পৃ. ৩৮৯-৭০)। (সমাপ্ত) - সূত্র - কেএস সিদ্দিকী : দৈনিক েইনকিলাব

0 comments:

Post a Comment