দুনিয়ার সুখ সুখ না, জান্নাতের সুখই আসল সুখ

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন কাজটি আল্লাহর নিকট সবচাইতে প্রিয়? তিনি বললেন, ‘ঠিক সময়ে নামায আদায় করা।’ তিনি (আবদুল্লাহ) পুনরায় বললেন, এরপর কোন কাজটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়? নবী (সাঃ) বললেন, ‘পিতামাতার সেবা ও আনুগত্য করা। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কোন কাজটি? জবাবে নবী (সাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা।

দুনিয়া ক্ষনস্থায়ী, নিশ্চই আমিও দুনিয়ায় ক্ষনস্থায়ী

“ তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের(কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” -সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০

দুনিয়ার দুঃখ দুঃখ না, জাহান্নারের দুঃখ আসল দুঃখ

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে এবং আমার উপর ঈমান এনেছে তার জন্য তো একবার মোবারকবাদ। আর যে আমাকে দেখে নাই তারপরেও আমার উপর ঈমান এনেছে তাকে বারবার মোবারকবাদ - মুসনাদ আহমাদঃ ৩/১০০

নামাজ বেহেস্তের চাবি

রাসুলে পাক (সা:) বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার উম্মতের উপর সর্বপ্রথম নামাজ ফরজ করেছেন এবং কেয়ামতের দিন সবার আগে নামাজের হিসাব নয়া হবে।

কালেমা পড়ি, ঈমান আনি, বলি আমি মুসলিম

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন কাজটি আল্লাহর নিকট সবচাইতে প্রিয়? তিনি বললেন, ‘ঠিক সময়ে নামায আদায় করা।’ তিনি (আবদুল্লাহ) পুনরায় বললেন, এরপর কোন কাজটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়? নবী (সাঃ) বললেন, ‘পিতামাতার সেবা ও আনুগত্য করা। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কোন কাজটি? জবাবে নবী (সাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা।

Sunday, September 20, 2015

ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্যে ভেজাল ও গুদামজাত

ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্যে ভেজাল ও গুদামজাত

মাওলানা আখতার হোসাইন

ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই। কুমারজীবন, দুনিয়াবিমুখতা ও সংসার-বিরাগ অশোভনীয় কাজ। এখানে গিরিগুহা কিংবা মসজিদে বসে আল্লাহর নাম জপ করায় পৌরুষ নেই। বরং জীবনের টানাপড়েন, বাজারের শোরগোল ও কারবারের ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহকে ভুলে না-যাওয়া পৌরুষের পরিচয়। এই ধর্মে কেবল আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর ইবাদতের কথাই বলা হয়নি; বরং নামাজের পর জীবিকা অন্বেষণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়- 'নামাজ সম্পন্ন হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো।' (সুরা জুমা : ১০)

নামাজের পর যে দোয়াটি রাসুল (সা.) বেশি বেশি পড়তেন, তা হলো- 'হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দান করো, আর আখিরাতেও কল্যাণ দান করো।' (সুরা বাকারা : ২০১)



অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'পরকালীন জীবনে আল্লাহ আপনাকে যা দান করবেন, আপনি তা অনুসন্ধান করুন। কিন্তু পার্থিব জীবনে আপনার ন্যায্য অংশের কথা আপনি ভুলে যাবেন না।' (সুরা কাসাস : ৭৭)

নিজ হাতে কামাই-রোজগার ও হালাল উপার্জনের নির্দেশ কেবল সাধারণ মুসলমানদেরই দেওয়া হয়নি; বরং যুগে যুগে সব নবী-রাসুলগণ এ ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, 'হে রাসুলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করুন এবং নেক কাজ করুন।' (সুরা মুমিনুন : ৫১)

ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে এ নির্দেশনা মোতাবেক নবী-রাসুলগণ নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করেছেন। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ ও তাঁতের কাজ করেছেন। হজরত ইদরিস (আ.) দর্জির কাজ করেছেন। হজরত হুদ ও ছালেহ (আ.) ব্যবসায়ী ছিলেন। হজরত ইব্রাহিম ও লুত (আ.) কৃষি পেশা গ্রহণ করেছিলেন। হজরত শুয়াইব (আ.) পশু বিচরণ করেছেন এবং বাজারে এগুলোর দুধ বিক্রি করতেন। হজরত দাউদ (আ.) লোহা দিয়ে নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বকরি পালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছিলেন।

ইসলামী শরিয়তে নিজ হাতে উপার্জিত খাবার গ্রহণে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, 'নিজ হাতে উপার্জিত খাবার থেকে উত্তম কোনো খাবার নেই; আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জিত খাবার খেতেন।' (বুখারি : ২০৭২)

অন্য হাদিসে এসেছে, 'ইমান আনার পর হালাল উপার্জন অন্যতম কর্তব্য।' (শুআবুল ইমান : ৮৩৬৭) মানবজীবনে অর্থ-সম্পদের প্রয়োজনীয়তা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের যত পথ ও পন্থা আছে, সেগুলো অবলম্বনে উৎসাহিত করেছেন। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল বলেছেন, 'কোনো মুমিন যখন গাছ লাগায় অথবা কৃষিজ ফসল ফলায়, অতঃপর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা পশু আহার করে; সেটি তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।' (বুখারি : ২৩২০)

ব্যবসার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) বলেছেন, 'সততা ও সত্যবাদিতা নিয়ে যারা ব্যবসায় পরিচালনা করবে, তারা কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে উঠবে।' (তিরমিজি)

শিল্প ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) একইভাবে উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। সে কারণেই রাসুলের জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের একটা বিরাট দল ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, কৃষি ও শিল্পে নিজেদের দক্ষতার গুণে বিপুল ধনৈশ্বর্যের মালিক হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের কেউ কেউ রাসুলের জবান থেকে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদও পেয়েছিলেন। হজরত ওসমান (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)- এ রকম অনেক সম্পদশালী সাহাবির নাম ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। বৈষয়িক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, বরং হালাল উপায়ে সম্পদসম্ভার উপার্জন করে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পার্থিব জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণই আসল ধার্মিকতা। তাই তো রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'দুনিয়াটা আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।'

রাসুল (সা.)-এর যুগে ব্যবসায়িক কার্যক্রম


রাসুল (সা.) আল্লাহর ইবাদত তথা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চা এবং দ্বীনি দাওয়াতের জন্য মদিনায় মসজিদ নির্মাণ করেছেন, তেমনি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মদিনায় তিনি ইসলামী বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বনু কায়নুকার বাজারটির পরিচালনার দায়িত্বভার তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। এ বাজারটির বৈশিষ্ট্য ছিল- এখানে কোনো রকম ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি, মাপে কম-বেশি করার বা পণ্যদ্রব্য মজুদ অথবা আটক করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার সুযোগই ছিল না। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) একদিন এক বিক্রেতার খাদ্যের স্তূপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাঁর হাত ওই খাদ্যের স্তূপে প্রবেশ করান, এতে তাঁর হাত ভিজে গেল এবং অনুপযুক্ত খাদ্যের সন্ধান পেলেন। তখন রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন, 'হে খাদ্য বিক্রেতা! এগুলো কী?' তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! খাদ্যগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন, 'তুমি এই ভিজা খাদ্যগুলো ওপরে রাখোনি কেন, যাতে সবাই তা দেখে নিতে পারে? যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়।' (মুসলিম : ১০২)

ওজনে কম দেওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, 'যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য রয়েছে বহু দুর্দশা, যারা মানুষের কাছ থেকে নেওয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয়, আর যখন অন্যকে ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদের এক মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সব মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে।' (সুরা মুতাফি্ফফীন, আয়াত : ১-৬)

ব্যবসা করা ইসলামে সুন্নত ও সৎকর্ম বলে গণ্য হলেও সব ধরনের ব্যবসা ইসলামে বৈধ নয়। যে ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি এবং হারাম জিনিস যেমন- মাদকদ্রব্য, শূকর, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদির ব্যবসা ইসলামে হারাম। নবী করিম (সা.) একদিন সালাতের জন্য বের হয়ে দেখতে পেলেন, লোকজন কেনাবেচা করছে। তখন তিনি তাদের ডেকে বলেন, 'হে ব্যবসায়ী লোকেরা! কিয়ামতের দিন কিছু ব্যবসায়ী মহা পাপীরূপে উঠবে; তবে তারা নয়, যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা, বিশ্বস্ততা সহকারে ব্যবসা করবে।' (তিরমিজি, হা. ১২১০)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'হে ব্যবসায়ীরা! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।' (তিবরানি)

পণ্যে ভেজাল মেশানো গর্হিত কাজ


পণ্যে ভেজাল মেশানো আমাদের দেশের অন্যতম সামাজিক অপরাধ। ভেজাল বলতে কেবল পণ্যসামগ্রীতে বর্জ্যপদার্থ, ভিনজাতীয় পদার্থ বা বিষ মেশানোকেই বোঝায় না; বরং ব্যবসায়িক লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়ে বস্তুর দোষত্রুটি গোপন করা, ওজনে কম দেওয়া, মিথ্যা তথ্য দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, আসল কথার বিপরীত করা, ভালোমানের পণ্যে নিম্নমানের পণ্য মিশ্রণ, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি ভেজালের অন্তর্ভুক্ত। আর সব ধরনের ভেজাল মিশ্রণ ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, 'হে আহলে কিতাবগণ! কেন তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে সংমিশ্রিত করছ এবং সত্যকে গোপন করছ।' (সুরা আলে ইমরান : ৭১)

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়।' (মুসলিম : ১০২) তিনি আরো বলেছেন, 'যদি তোমার পণ্যদ্রব্যে কোনো দোষ থাকে, তবে তা কখনো গোপন করবে না। কেননা তা গোপন করলে ব্যবসায় বরকত আসে না।' (বুখারি ও মুসলিম)। অন্য হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রি করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে ফিরে তাকাবেন না।' (সহিহ বুখারি)

মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সম্পর্কে ইসলামের বিধান


খাদ্যদ্রব্য মজুদ করা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করাকে ইসলাম অবৈধ করেছে। হানাফি মাজহাব মতে তা মাকরূহে তাহরিমি (হারাম সমতুল্য) হলেও অন্যান্য মাজহাব মতে এটি হারাম। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। তাই ইসলাম এ প্রকার কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহপাক তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।' (আবু দাউদ : ৫৫)

ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ। রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অভিশপ্ত।' (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, 'যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।' (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬) অন্য হাদিসে এসেছে : 'যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।' (আল মু'জামুল কাবির : ১০৮৬)

তবে গুদামজাত পণ্য যদি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু না হয় কিংবা মানুষ এর মুখাপেক্ষী না হয় অথবা এসব পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত হয় বা গুদামজাতকারী বর্ধিত মুনাফা অর্জনের অভিলাষী না হয়, তাহলে এসব অবস্থায় পণ্য মজুদ রাখা অবৈধ নয়।

Saturday, September 19, 2015

নামাজ বা সালাতের গুরুত্ব

 নামাজ বা সালাতের গুরুত্ব


নামাজ হলো ঈমানের চার্জ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আপনি মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করার মধ্য দিয়ে আপনার ঈমানকে চার্জ দিতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে ঈমানের এ চার্জকে আপনি কাজে লাগাবেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চলবেন। কেননা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার প্রশিক্ষণ আপনি সালাতের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন।


ভণ্ড পীর বাবাদের নষ্ট উপাখ্যান



 এবারের বাবা দিবসে বাবার কথা নয়, বাবাদের বাবার কথা বলবো। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের ( সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ) শেষ যুগ হলো কলি যুগ বা পাপের যুগ। বেদব্যাস রচিত বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে যে কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গারোহণের সময় থেকে পৃথিবীতে কলি যুগের সূচনা হয়েছে। কলি যুগে পাপের পরিমাণ যেমন পূণ্যের তিনগুণ তেমনি এ সময়ে ঘরের বাবার চেয়ে বাইরের বাবার পরিমাণও শতগুণ। আমাদের চারিদিকে আজ বাবা আর বাবা- বিড়ি বাবা, টাইগার বাবা, হাঁটা বাবা, চুমু বাবা, ফুঁ বাবা, লাঠি বাবা, ল্যাংটা বাবা, শিকল বাবা, পানি বাবা …। বাবারে বাবা, কতো বাবা!

Friday, September 18, 2015

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত



সপ্তাহের সাত দিনের মাঝে জুমাবারটি যেমন বিশেষ মর্যাদায় পূর্ণ, বছরের ১২ মাসের মধ্যে রমজান মাসটি যেমন অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, রমজানের ভেতরেও আবার শেষ দশকটি তুলনামূলক বেশি মর্যাদাপূর্ণ, ঠিক তেমনি জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদায় ভাস্বর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মাসের প্রথম দশকের রাতগুলোর নামে কসমও করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘শপথ প্রভাতের, শপথ দশ রাত্রির।’ [সূরা ফজর : ১-২]। মহান প্রতিপালকের এ কসম করা থেকেই এ দশকের বিশেষত্ব স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। 

সাধারণভাবে কোনো দিন-মাস কিংবা কোনো সময়ের বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হলে আমাদের উচিত- সে সময়টাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া। বেশি বেশি ইবাদত করা। যদি সে বিশেষ সময়ের কোনো বিশেষ আমলের কথা কুরআনে বা হাদিসে বর্ণিত হয়ে থাকে, তাহলে তা মনোযোগসহ আদায় করা। অন্যথায় যেকোনো নফল ইবাদত যেমনÑ নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি বেশি বেশি করা এবং ফরজ আমলগুলো ঠিক ঠিক আদায় করা। মহিমান্বিত এ দশকের ইবাদত সম্পর্কে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে : ‘এ দশ দিনের কোনো নেক আমল আল্লাহর কাছে যত প্রিয়, অন্য কোনো সময়ের আমল তাঁর কাছে এতটা প্রিয় নয়।’ [তিরমিজি শরিফ, হাদিস নম্বর ৭৫৭]।
এ দশকের আমলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হজ। ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্যতম এ মহান আমলটি সংঘটিত হয় এ মাসেই এবং এ দশকেই। হজের মাস তো শুরু হয়ে যায় রমজান-পরবর্তী শাওয়াল মাস থেকেই। সেটা হচ্ছে কেবল হজের নিয়ত বা ইহরাম করার সময়। শাওয়াল থেকে শুরু করে হজের আগপর্যন্ত যেকোনো সময়ই এ ইহরাম বাধা যায়। শাওয়াল মাস থেকেই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বায়তুল্লাহর উদ্দেশে মুসলমানগণ ছুটে আসতে শুরু করেন। কিন্তু হজের নির্ধারিত সময় সবার জন্যই এক। জিলহজের ৯ তারিখে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজের প্রধান ফরজ। পরদিন ১০ তারিখে তাওয়াফে জিয়ারত করতে হয় এবং এ তাওয়াফ করাও ফরজ। হজের কাজগুলো যদিও ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত, কিন্তু ৯ তারিখের এ আরাফার মাঠে অবস্থানই হজের মূল কাজ। সময়মতো এ আমল আদায় না হলে হজই আদায় হবে না। 
কিন্তু বরকতময় এ হজের কাফেলায় তো সব মুসলমান শরিক হতে পারেন না। বরং ব্যয়বহুল ও কষ্টকর এ ইবাদতটি জীবনে মাত্র একবারই ফরজ। তাও যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য। কেউ কেউ অবশ্য একাধিকবারও হজ পালন করতে যান। কেউ কেউ বারবার যান। তবে যারা এতে শরিক হতে পারছেন না তাদের জন্য রয়েছে কোরবানির বিধান। হাজীগণ ৯ জিলহজ আরাফার মাঠে অবস্থান শেষে রাতে রওনা হন মুজদালিফার দিকে। সেখানে সকাল পর্যন্ত থেকে চলে যান মিনায়। মিনায় গিয়ে জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয় এবং করতে হয় কোরবানি। আল্লাহর আদেশ ও ভালোবাসার সামনে হজরত ইব্রাহিম আ: আপন পুত্র হজরত ইসমাইল আ:-এর প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে তাকে যে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন এবং সে জন্য চেষ্টাও করেছিলেন, এরই স্মৃতিবিজড়িত আমল হচ্ছে এ কোরবানি। হজের সাথে মিল রেখে অন্য মুসলমানদের জন্যও এ দিনে কোরবানির বিধান দেয়া হয়েছে। যেন এ মহান আমলটিতে শরিক হতে না পারলেও নিজ নিজ জায়গা থেকেই এর সাথে কিছুটা সাদৃশ্য কমপক্ষে অবলম্বন করা যায়। 
ইহরাম বাঁধার পর থেকে হাজীগণ নখ, চুল কিছুই কাটতে পারেন না। ১০ তারিখে পাথর মেরে কোরবানি করার পর তারা চুল মুণ্ডিয়ে কিংবা ছেঁটে হালাল হন এবং নখ-চুল না কাটার বিধান থেকে বেরিয়ে আসেন। ঠিক একইভাবে যারা হজে না গিয়েও কোরবানি দেবেন, হাদিস শরিফে তাদেরকেও বলা হয়েছেÑ যেন জিলহজ মাস আসার পর নখ-চুল কিছুই না কাটে। কোরবানি আদায় করার পর তাদের নখ-চুল কাটবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কেউ যদি কোরবানি দিতে চায়, তাহলে জিলহজ মাস আসার পর যেন সে আর তার নখ-চুল না কাটে।’ [মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ৫২৩৩]। হজপালনরত ভাগ্যবানদের জন্য ক্ষণে ক্ষণে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে রহমত নাজিল হতে থাকে, কোরবানি ও এর আগে ১০ দিন নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থেকে তাদের সাথে সামান্য সাদৃশ্য অবলম্বন করে আশা করা যায়Ñ সে রহমত কিছুটা হলেও আমাদের ভাগ্যে জুটবে। 
এ দশকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নফল ইবাদত হচ্ছে আরাফার দিনে অর্থাৎ ৯ জিলহজ রোজা রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা:’কে আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘তাতে আগের ও পরের দুই বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ [মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ২৮০৪]।
সূত্র - নয়া দিগন্ত

Thursday, September 17, 2015

জমজম এর পানি মহান আল্লাহ এক অপার রহমত


 জমজম এর পানি মহান আল্লাহ এক অপার রহমত


জমজম পানির উৎসটি বিশ্বের এক চিরকালীন বিস্ময়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এটি মানব জাতির কাছে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করছে। খানায়ে কাবার কাছে (হজরে আসওয়াদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে) অবস্থিত বেহেশতি পানির এই উৎসটির কয়েকটি অসাধারণ দিক হলো : ১) প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকে সব সময়েই (মাঝে জাহেলিয়াতের যুগের কিছু সময় বাদ দিয়ে) তার পানির উচ্চতা একই অবস্থানে বিদ্যমান রয়েছে। কোনো পরিস্থিতিতেই তার পানি কমেনি। ২) কখনোই পানির উৎস নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। ৩) জমজমের পানি যত খুশি পান করা যাবে, কিন্তু তবুও সেই পানির কোনো ঘাটতি হবে না। 

জমজম কূপটি আবিস্কারের সাথে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) এবং তার পরিবারের স্মৃতি জড়িত রয়েছে। হযরত ইবরাহিমের (আ.) দুই স্ত্রী ছিলেন- হযরত সারাহ ও হযরত হাজেরা।
হযরত ইবরাহিম (আঃ) ৮৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় স্ত্রীর মাধ্যমে প্রথম পুত্র সন্তান হযরত ইসমাইলকে (আ.) লাভ করেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত ইবরাহিমকে (আ.) তার প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত বিবি হাজেরা এবং দুগ্ধপোষ্য পুত্র হযরত ইসমাইলকে (আ.) জনমানবশূন্য বিরান ও শুস্ক মরুভূমি মক্কায় রেখে আসার নির্দেশ দেন। হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর এই নির্দেশ মেনে নিয়ে মাত্র এক ব্যাগ খেজুর এবং এক মশক ভর্তি পানিসহ তাদের সেখানে রেখে আসেন।

আল্লাহর এই নির্দেশ বিবি হাজেরাও মেনে নিলেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি শিশুপুত্রকে নিয়ে একাকী সেই নির্জন মরুতে থেকে গেলেন। স্ত্রী-পুত্রকে মরুভূমিতে রেখে যাওয়ার সময় হযরত ইবরাহিম (আ.) বিশেষ করে পানির জন্য দোয়া করলেন। তার দোয়া কবুল হয়েছিল।
হযরত ইবরাহিমের (আ.) রেখে যাওয়া খেজুর ও পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় হযরত হাজেরা পাগলপ্রায় হয়ে যান। বিশেষ করে শিশুপুত্র হযরত ইসমাইলের জীবন বাঁচানোর চিন্তায় তিনি কাতর হয়ে পড়েন। পানি ও মাতৃদুগ্ধের অভাবে তিনি মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। তাই পানির সন্ধানে ছেলেকে রেখে বিবি হাজেরা কাছে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ছুটাছুটি করতে থাকলেন। তিনি সম্ভবত দেখতে চাচ্ছিলেন, আশে পাশে কোনো কাফেলার দেখা পাওয়া যায় কিনা, যাদের কাছ থেকে খাবার, পানি নেওয়া যায়। তার সেদিনের এই ছোটাছুটিকে স্মরণ রাখার জন্য এখনো ওমরাহ ও হজ্জের সময় ওই পাহাড় দুটি সায়ী করা হাজিদের জন্য বাধ্যতামূলক। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটিতে সাতবার দৌড়াদৌড়ি শেষে হতাশ হয়ে তিনি ছেলের কাছে ফিরে আসেন। সেখানে তার জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি দেখলেন, হযরত ইসমাইলের পায়ের কাছে পানির এক চমৎকার উৎস সৃষ্টি হয়েছে। হযরত ইসমাইলের (আ.) পায়ের আঘাতে কিংবা হযরত জিব্রাইলের (আ.) ডানার ঝাপটায় এই উৎসের সৃষ্টি হয়েছে। এই পানি দেখে তিনি খুব খুব খুবই খুশি হলেন। তিনি ও হযরত ইসমাইল (আ.) সেই পানি পান করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। তারা বেঁচে থাকার অবলম্বন পেলেন। 

বলা হয়ে থাকে, হযরত হাজেরা জমজমের উৎসের চারদিকে বালির দেওয়াল তোলায় তা সেখানেই কেন্দ্রীভূত এবং নিয়ন্ত্রিত থাকে। তিনি এসময় বলছিলেন ‘জমজম (থামো বা এখানেই থাকো)’। এ কাজ করা না-হলে এই পানি কত দূর ছড়িয়ে পড়তো, আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। সেই থেকে কূপটির নামও হয় জমজম।
মক্কায় জমজম কূপ আবিস্কারের পর স্থানটি দ্রুত আকর্ষণীয় এলাকায় পরিণত হলো। আশপাশের লোকজন সেখানে সমবেত হতে লাগলো। একটি সভ্যতার সূচনার পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
ইয়েমেন থেকে আসা ‘জারহাম’ গোত্র বিবি হাজেরার কাছে মক্কায় ফসল ফলানো এবং তা ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি প্রস্তাব করল। তারা সমঝোতায় পৌঁছল। তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেছিল, কাবা ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও পেয়েছিল।
পরে তারা পুরোপুরি অনাচার ও অবিচারে নিমজ্জিত হলো। পরিণতিতে জমজমের পানি শুকিয়ে গেল। অন্য একটি ভাষ্যে দেখা যায়, জারহাম গোত্র যখন আল্লাহ দেয়া সীমারেখা অতিক্রম করেছিল, তখন কিনা ও খাইজা নামে দুটি গোত্র তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। প্রচ- লড়াইর পর জারহাম গোত্র হেরে যায়। তবে তারা বিতারিত হওয়ার আগে বড় বড় পাথর এবং অন্যান্য সামগ্রী জমজমের উৎসে ফেলে দিয়ে তা ভরাট করে ফেলে। তারা এমন নিখুঁতভাবে এই কাজটি করেছিল যে জমজমের উৎস একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল।
বলা হয়ে থাকে হযরত ইসমাইল (আ.) জারহাম গোত্রে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু তার ইন্তেকালের পর তারাই খানায়ে কাবা এবং জমজমের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসে। এই ঐশ্বর্যই তাদের পতন ত্বরান্বিত করে। এই প্রেক্ষাপটেই কিনা এবং খাইজা গোত্র তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তবে আরেকটি ভাষ্যে দেখা যায়, বিবাহের পর ইসমাইল (আ.) নিজেই কূপটি ভরাট করে মক্কা ত্যাগ করেন।


এর পর দীর্ঘ সময় জমজম উৎস সবার অগোচরে থাকে। মহানবির (সা) জন্মের পর তার দাদা কোরাইশ নেতা আাব্দুল মোতালেব আবার খননকাজ চালান। সুরা ফিলে বর্ণিত আবরাহার হস্তি বাহিনীর আক্রমণের ঘটনার পর তিনি ক্রমশ ধনী ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছিলেন। তিনি একদিন স্বপ্নে দেখলেন, মানব কল্যাণে আল্লাহ তাকে জমজম খনন করার আদেশ দিচ্ছেন। প্রথমে তিনি সঠিক জায়গায় খনন কাজ চালাতে পারেননি। আরেক দিন স্বপ্নে তিনি সঠিক জায়গাটির হদিস পান। সেই অনুযায়ী আব্দুল মোতালেব তার তখন পর্যন্ত একমাত্র ছেলে হারিসকে নিয়ে জমজম খনন করতে থাকেন। তাদের কয়েক দিনের প্রয়াসের ফলে আবার জমজমের পানি বের হয়ে আসে। মোতালেবের মোট ১০ ছেলে ছিল। তবে জমজম আবিস্কারের পর বাকি ৯ ছেলে জন্মগ্রহণ করে। সেই থেকে সাড়ে ১৪ শত বছর ধরে সেই একই স্থানে বহাল রয়েছে আবে জমজম।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তারিক হোসাইন জমজম কূপে গবেষণা চালনা করেন। তাতে দেখা যায়, কূপটির আয়তন হচ্ছে: ১৮ ফুট বাই ১২ ফুট বাই ৫ ফুট। তিনি জমজমের পানির নমুনার ক্যামিক্যাল এবং বায়োলজিক্যাল পরীক্ষাও করেন। এর আগে মিসরীয় জনৈক চিকিৎসক বলেছিলেন, মক্কার পয়োঃনিস্কাশনের পানিই জমা হয় জমজমে। কিন্তু তারিক হোসেনের গবেষণায় তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মক্কা নগরীটি শক্ত, গ্রানাইট পাথরের পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত। হারাম শরিফটি (মসজিদুল হারাম) উপত্যকার সর্বনিম্ন অবস্থানে। স্থানটিতে ৫০ থেকে ১০০ ফুট গভীর আগ্নেয়শিলার আবরণ রয়েছে। জমজম কূপটি এমন একটি জায়গায় অবস্থিত এবং এর পানির উচ্চতা প্রাকৃতিক ভূমিস্তরের ৪০ থেকে ৫০ ফুট নিচে। এই পানি কখনো বন্ধ হবার নয়।
১৯৬৮ সালে একবার মক্কায় বন্যা দেখা গিয়েছিল। পানি ৭ ফুট উঁচুতে উঠেছিল। জমজম কূপেও ঢুকেছিল বন্যার পানি। তাই বন্যার পর নোংরা পানি জমজম থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটি মোটর পাম্প লাগানো হয়। মনে করা হয়েছিল পাম্প দিয়ে জমজমের সব পানি দ্রুত সরিয়ে নিলে পরে বিশুদ্ধ পানিই আসবে সেখানে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পানি উত্তোলনের পর জমজমের পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তাই সেই চেষ্টা বাদ দেওয়া হলো।
জমজমের পানির উৎস তিনটি বলে ধারণা করা হয়
১) কাবা ঘরের নিচ থেকে রুখনে বা হাজরে আসওয়াদ হয়ে জমজম পয়েন্টে।
২) সাফা পাহাড়ের নিচ থেকে জমজম পয়েন্টে।
৩) মারওয়ার নিচ থেকে জমজম পয়েন্টে।
জমজমের মুখ থেকে ৪০ হাত পর্যন্ত প্লাস্টার করা। তার নিচে পাথর কাটা অংশ আরো ২৯ হাত। এসব লাল পাথরের ফাঁক দিয়েই তিনটি প্রবাহ থেকে আসে পানি।
জমজমের পানি অত্যন্ত পবিত্র এবং পৃথিবীর কোনো পানির সাথে তার তুলনা হয় না। অত্যন্ত স্বচ্ছ এই পানিতে বিন্দুমাত্র দূষণ দেখা যায় না। রোগ জীবাণু কিংবা কাদামাটি বা আবর্জনাও দেখা যায় না। জমজমের পানিকে কেবল বেহেশতের আবে কাউসারের সাথে তুলনা করা যায়। এই বিশুদ্ধ পানি অত্যন্ত রুচিকর। উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ এই পানি খেয়েই জীবনধারণ করা যায়। হযরত আবু জর গিফারি (রা.) একবার টানা ৩০ দিন এই পানি পান করে জীবনধারণ করেছিলেন। মহানবি (সা.) এবং সাহাবাদের স্মৃতিধন্য এই পানির প্রতি সব মুসলমানের অকৃত্রিম আকর্ষণ রয়েছে। হজ বা ওমরাহ কিংবা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে কেউ মক্কায় যাবে, অথচ জমজমের পানি পান করবে না, কেউ তা কল্পনাও করতে পারে না। তারা নিজেরা তো এই পানি পান করেনই, আর সাথে করে পর্যাপ্ত পানি নিয়ে যান আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিদের জন্য। মাসের পর মাস বছরের পর বছর জমজমের পানি নানাভাবে দূর দুরান্তে মুসল্লিরা নিয়ে যাচ্ছে। কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়াই এই পানি মাসের পর মাস স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে অটুট থাকছে। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তেও এই পানি পৌঁছে যাচ্ছে বিশুদ্ধ অবস্থায়। বর্তমানে সৌদি সরকার এই পানি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মক্কাতেও আরো কয়েকটি কূপ আছে। কিন্তু তার কোনোটিই জমজমের মতো নয়। তেমন বেশি পানিও সরবরাহ করতে পারে না সেগুলো। এমনকি পৃথিবীর অন্য সব জায়গায় সেসব কূপ আছে সেগুলোও কয়েক বছর পর শেওলা জমে যায়, পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। একপর্যায়ে সেগুলো আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। অথচ জমজমে প্রতিনিয়ত পানি থাকছে। হজের সময় প্রায় লাখ লাখ হাজির পানির যোগান দিয়ে যায় এই জমজম। কখনো তার পানিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি।
বিভিন্ন উৎস থেকে ধারণা করা হয়ে থাকে জমজমের উৎস হয়েছিল এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এই হিসাবের ভিত্তি হলো- হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত মুসার (আ.) মধ্যকার সময়ের পার্থক্য ১,০০০ বছর। হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসার (আ.) সময়ের পার্থক্য ১,৯০০ বছর । আবার হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত মোহাম্মাদের (সা.) পার্থক্য ৫৬৯ বছর। তাই বলা যায় হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত মোহাম্মাদের (সা.) মধ্যকার সময় হচ্ছে ৩,৪৬৯ বছর।
কেউ যদি আল্লাহর কুদরত দেখতে চায়, তাদের জন্য একটি কুদরত হতে পারে এই জমজম কূপ।

সূত্র - দৈনিক নয়াদিগন্ত।

Thursday, September 10, 2015

মাতৃভক্ত পুত্রের বিরল সততার কথা কোরআনে বর্ণিত গাভী জবাই প্রথা

মাতৃভক্ত পুত্রের বিরল সততার কথা 

কোরআনে বর্ণিত গাভী জবাই প্রথা

হজরত মুসা (আ.)-এর জ্বালাতনকারী হঠকারী কওম বনি ইসরাইলের অপকর্মের বিবরণ  কোরআনের অসংখ্য স্থানে বিবৃত হয়েছে। গরুকে কেন্দ্র করে তারা যে তেলেসমাতি কা-কারখানা ঘটিয়েছিল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গরুর নামে সূরা বাকারা নামকরণ করা। একটি বেহুদা বিষয় হজরত মুসা (আ.)-কে আল্লাহর দরবারে বারবার জিজ্ঞাসা করতে প্রেরণ করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, বনি ইসরাইল কত বড় বেয়াড়া ও কুতার্কিক জাতি ছিল। এহেন আচরণের খেসারতও তাদের দিতে হয়েছে সুদীর্ঘ ৪০ বছর। তাদের বোকামি ও অপরিণামদর্শিতার প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের একটি গরু জবাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র, তারা একটি যে কোনো প্রকারের গরু জবাই করলেই যথেষ্ট ছিল। হুজুর (সা.)-এর এ ছোট্ট বক্তব্যে বিরাট শিক্ষা নিহিত রয়েছে, আর তা হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় ও বেহুদা কথা বললে তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হতে পারে, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বনি ইসরাইলের গরুর ঘটনা। সূরা বাকারার ৬৭ হতে ৭৩নং আয়াত পর্যন্ত গরুর কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। কোরআনসহ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত কাহিনীটি এরূপ:বনি ইসরাইলে আমিল নামক এক ধনী ব্যক্তি ছিল। তার এক ভাতিজা ব্যতীত আর কোনো ওয়ারিশ ছিল না। চাচার মৃত্যুতে বিলম্ব দেখে ওয়ারেশি সম্পদের লোভে ভাতিজা তার চাচাকে হত্যা করে এবং তার লাশ নিয়ে অন্য গ্রামে ফেলে আসে স্থানীয় লোকেরা তার লাশ দাফন করে। ঘটনাটি ছিল রাতের। পরের দিন ভাতিজা চাচার খুনের দাবিদার হয় এবং মহল্লার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং তার চাচার খুনের দাবি পেশ করে। হজরত মুসা (আ.) লোকদের নিকট নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, সবাই অস্বীকার করে। তাই নিহত ব্যক্তির ব্যাপারটি হজরত মুসা (আ.)-এর নিকট সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ে। লোকেরা হজরত মুসা (আ.)-কে অনুরোধ জানায়, তিনি যেন আল্লাহর দরবারে নিহত ব্যক্তির অবস্থা প্রকাশের জন্য দোয়া করেন। তিনি দোয়া করেন এবং আল্লাহর দরবার  হতে নির্দেশ আসে একটি গরু জবাই করার। বনি ইসরাইল সহজ-সরলভাবে নির্দেশ পালন না করে বারবার নানা প্রশ্ন করে জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে এবং আল্লাহর দরবার হতেও কঠিন শর্ত আরোপ করা হতে থাকে, যার বিবরণ কোরআনে রয়েছে। তবে কিভাবে আল্লাহর নির্দেশিত গরুর সন্ধান লাভ করে তার উল্লেখ না থাকলেও তারা ইনশাল্লাহ বলেছিল বলে তারা সেই গরু পেয়েছিল এবং তা জবাই করে গরুর অংশ বিশেষ নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করলে সে জীবিত হয়ে বলে দিয়েছিল, তার ভাতিজাই তার হত্যাকারী। হত্যাকারীর কি শাস্তি হয়েছিল কোরআনে তার উল্লেখ নেই। তবে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তওরাতে মিরাসের বিধান অবতীর্ণ হয় বলে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।ইনশাল্লাহ বলার ফলে আদিষ্ট গরু পাওয়া যায় বলেও বর্ণনা রয়েছে। এ কথার তৎপর্য কি? আল্লাহ চাইলে এ বাক্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা উচ্চারণ করেনি আদিষ্ট গরুর সন্ধান তারা পায়নি। এ কথা বলার পরই তারা গরুর খোঁজ পায়। ইনশাল্লাহর মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ধারণা নিহিত রয়েছে। এ বাক্য উচ্চারণ করার ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় কাজ সমাধা হয়ে যাওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই যে কোনো ভালো কাজ করার পূর্বে আল্লাহর ওপর ভরসা করা অর্থাৎ ইনশাল্লাহ বলে আরম্ভ করা উচিত। বনি ইসরাইলের এ ঘটনায় তার শিক্ষা রয়েছে। হত্যাকারী শনাক্তকরণে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী গরু সন্ধানের ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে একটি বর্ণনা নি¤œরূপ :বনি ইসরাইলে একজন ছালেহ বা সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তার এক পুত্র ও একটি গরু বাছুর ছিল। একদিন তিনি গরুর বাছুরটি জঙ্গলে নিয়ে যান এবং আল্লাহর দরবারে এই মর্মে প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! এ বাছুরটি তোমার সফরদ করছি যাতে আমার ছেলে বড় হলে এটি তার কাজে আসে। বাছুরটি জঙ্গলে ছেড়ে আসার কিছুদিনের মধ্যে লোকটির মৃত্যু ঘটে এবং বাছুরটি জঙ্গলে যৌবনে পৌঁছে। বাছুরটির অবস্থা ছিল এই যে, কোনো লোক যদি তার কাছে আসার চেষ্টা করত তাকে দেখামাত্র সে দূরে পালিয়ে যেত।মায়ের অত্যন্ত ভক্ত, অনুগত ও খেদমতগুজার ছেলেটিও বড় হয় এবং যৌবনে পৌঁছে। তার অবস্থা ছিল এই যে, রাতের অংশকে সে তিন ভাগে ভাগ করত, এক ভাগ তার মায়ের সেবাযতেœ কাটাতো, এক ভাগ আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো এবং নিজের আরামে ব্যয় করতো। ভোরে উঠে সে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ বা লাকড়ি সংগ্রহ করতো এবং বাজারে নিয়ে গিয়ে তা বিক্রি করতো। বিক্রিলব্ধ অর্থও সে তিন ভাগে ভাগ করতো। এক অংশ দান-সদকা করতো, এক অংশ নিজের খাবারে ব্যয় করতো এবং এক অংশ তার মাকে প্রদান করতো। ছেলেটির মা একদিন তাকে বলল, তোমার পিতা মিরাহ বা উত্তরাধিকার হিসেবে একটি গরুর বাছুর রেখে যান এবং ওটা আল্লাহর নামে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, তুমি সেখানে যাও এবং হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.), হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর নিকট দোয়া করো যেন তিনি ঐ বাছুরকে তোমার সমর্পণ করেন। বাছুরটির পরিচয় হচ্ছে, তুমি যখন তাকে দেখবে তখন তার চামড়া হতে সূর্যের উল্কার ন্যায় আলোক নির্গত হচ্ছে মনে হবে। তার অপূর্ব সৌন্দর্য ও হলদে বর্ণের কারণে সে সোনালি হয়ে গেছে। ছেলেটি তার মায়ের কথা মতো জঙ্গলে গিয়ে বাছুরটিকে দেখতে পায়। সে চিৎকার করে বলল, হে গাভী! হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.),  হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রভুর দোহাই দিয়ে আমি তোকে বলছি, তুই আমার নিকট চলে আয়। এ কথা শোনামাত্র গাভী দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ছেলেটি তার গর্দানে হাত দিয়ে হাকাতে হাকাতে তার গৃহের দিকে চলতে থাকে। আল্লাহর নির্দেশে গাভী বাকশক্তির অধিকারী হয়ে বলে ওঠে, তুমি আমার পিঠে সোয়ার হয়ে যাও, এতে তোমার আরাম হবে, যাত্রা সহজ হবে। ছেলে বলল, আমি এরূপ করবো না। কেননা, আমার মা আমাকে সোয়ার হওয়ার জন্য বলেননি বরং বলেছেন যে, তার ঘাড় ধরে নিয়ে যেতে।  গাভী বলল, ভালোই হলো, তুমি আমার ওপর সোয়ার হলে না। এরূপ হলে আমি কিছুতেই তোমার নিয়ন্ত্রণে আসতাম না। আর তোমার মায়ের সেবা-তাঁবেদারির কারণে তোমার মধ্যে এমন শানমর্যাদার সৃষ্টি হয়েছে যে, তুমি যদি পর্বকে নির্দেশ করো, মূল থেকে ওপড়ে তোমার সাথে আসতে, তাহলে সে তাই করবে।মায়ের প্রতি আনুগত্য, সেবার প্রতি পশুর জবানবন্দি প্রমাণ করে যে, সন্তানের কাছে মায়ের স্থান কত ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। তাই ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল-জান্নাতু তাহতা আকদামিন ওমমাহাতা অর্থাৎ মায়েদের পদতলে বেহেশত। মায়েদের প্রতি তথা জননীকুলের প্রতি ইসলামপূর্ব বর্বর জাহেলী যুগে কি নির্যাতনমূলক আচার-আচরণ ও দুর্ব্যবহার করা হতো তার লোমহর্ষক বিবরণ অজানা নেই কারো তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তাকে উচ্চমর্যাদায় আসীন করেছে। গাভীকে বাকশক্তি দান করে আল্লাহতায়ালা তার মুখ দিয়ে মায়ের মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাকশক্তির অধিকারী, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে।ছেলেটির কথায় ফিরে আসা যাক। ছেলেটি যখন গাভীটি নিয়ে তার মায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, তখন তার মা বলল, বেটা, তুমি দরিদ্র। তোমার কাছে টাকা-পয়সা ও অর্থ নেই। সারারাত জাগ্রত থাকা এবং দিনে কাঠ সংগ্রহ করা তোমার পক্ষে খুব কষ্টকর কাজ। তাই তুমি এ গাভী বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দাও। ছেলে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো, কত হলে বিক্রি করবো। মা বললো, তিন দিনারে বিক্রি করবে, তবে বিক্রি করার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমার পরামর্শ ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। তখনকার মূল্য অনুযায়ী গাভীটির মূল্য ছিল তিন দিনার। ছেলে গাভীটি বাজারে নিয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়ালা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন সৃষ্টির প্রতি তার অসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে এবং এ ছেলের পরীক্ষার জন্য। সে তার মায়ের অনুগত্য কতটুকু করে তা দেখাও আল্লাহর ইচ্ছা। ফেরেশতা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাভীটি কত দামে বিক্রি করবে? জবাবে সে বলল, তিন দিনার দামে বিক্রি করবে। তবে শর্ত হলো আমার মা যদি তাতে রাজি থাকেন। ফেরেশতা বললেন, আমি এর মূল্য তোমাকে ছয় দিনার দেব। শর্ত হলো, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করতে পারবে না। ছেলে জবাবে বলল, তুমি যদি গাভীর শরীরের লোম পরিমাণও আমাকে তার মূল্য দিতে চাও আমি তা গ্রহণ করবো না, যতক্ষণ না আমার মায়ের সাথে পরামর্শ করবো। তার অনুমতি ছাড়া গাভী আমি বিক্রি করবো না। অতঃপর ছেলে তার মায়ের কাছে গিয়ে জানায়, এক ব্যক্তি গাভীটির মূল্য ছয় দিনার দিতে চায়। মা বলল, আমার অনুমতিসহ ছয় দিনারে বিক্রি করে দাও। ছেলে গাভীটি নিয়ে আবার বাজারে যায়। ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করেছ? ছেলে বলল, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করেছি, মা বলেছেন যে, আমার অনুমতি ছাড়া ছয় দিনারের কমে বিক্রি করবে না। ফেরেশতা বললেন, আচ্ছা আমি তোমাকে এর মূল্য বারো দিনার প্রদান করবো। শর্ত হচ্ছে তোমার মায়ের অনুমতি নিতে পারবে না। ছেলে বলল, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এ কথা বলে সে গাভীটি নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে এবং তার মাকে অবস্থা বর্ণনা করে।ছেলের বিবরণ শুনে মা বলল, বেটা! সম্ভবত লোকটি মানুষের আকারে কোনো ফেরেশতা হবে এবং তোমার পরীক্ষা করতে চাইছে যে, তুমি মায়ের আনুগত্যে কতটুকু অটল আছ। এবার যদি সে তোমার কাছে আসে তাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, আমাদের গাভীটি আমাদের বিক্রি করতে দেবে, নাকি দেবে না। সুতরাং ছেলে যায় এবং অনুরূপ বলে। এবার ফেরেশতা ছেলেকে বললেন যে, তোমার মাকে গিয়ে বলে দাও যে, গাভীটি এখন বেঁধে রাখতে এবং বিক্রি করার ইচ্ছা হতে আপাতত বিরত থাকতে। কেননা, হযরত মুসা (আ.)-কে একজন নিহত ব্যক্তির ব্যাপারে একটি গাভীর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তিনি এ গাভী খরিদ করবেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ গাভীর লোম (কেশ) পরিমাণ সোনা দেবেন না গাভীটি বিক্রি করবে না। তাই ফেরেশতার পরামর্শ অনুযায়ী তারা গাভীটি বেঁধে রাখে।আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এবং মায়ের প্রতি ছেলের আনুগত্যের প্রতিদান হিসেবে অবিকল অনুরূপ গাভী জবাই করার জন্য নির্ধারণ করেন। সুতরাং বনি ইসরাইলকে যখন গাভী জবাই করার নির্দেশ প্রদান করা হয় তখন তারা বারবার তার গুণাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। তাই তাদের জন্য অবিকল ঐ গাভী নির্ধারিত হয়।অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, বনি ইসরাইলে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। তার একটি গো বাছুর ছিল। সে তা জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং বলে, হে আল্লাহ! আমার ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি এ বাছুর তোমার হেফাজতে দিচ্ছি। সুতরাং ছেলে বড় হয়, সে ছিল মায়ের অত্যন্ত অনুগত। গো বাছুরটিও জঙ্গলে বড় হয় এবং গাভী বয়সের হয়ে যায়। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, সুন্দর ও মোটাতাজা। বনি ইসরাইল ঐ এতিম ছেলে ও তার মায়ের কাছ থেকে তা সওদা করে এবং তার চামড়া সমান সোনা প্রদান করে। তখন ঐ গাভীর মূল্য তিন দিনার। উল্লেখ্য, বনি ইসরাইল ৪০ বছর পর্যন্ত এ গাভীর সন্ধানে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল এবং বহু চেষ্টা-তদবিরের পর এ আদিষ্ট গাভীর সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। গাভী সম্পর্কে তাদের নানা অবান্তর ও বেহুদা প্রশ্নের জবাবও আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে যায়। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন : বনি ইসরাইল যদি নির্দেশ পাওয়ামাত্র যে কোনো একটি গাভী জবেহ করে দিতো তা যথেষ্ট হতো, কিন্তু তারা কঠোরতা অবলম্বন করায় আল্লাহতায়ালাও তাদের বিষয়টি কঠিন করে দেন এবং ইসতিকমা করা নাহুসাত বা অশুভ।ইসতিকমা-এর আভিধানিক অর্থ দূরত্ব সৃষ্টি করা, দূরে চলে যাওয়া ইত্যাদি পারিভাষিক অর্থে কোনো সহজ বিষয়কে জটিল করা, কঠিন করা। এরূপ করাকে রাসূলুল্লাহ নাহুসাত বা অশুভ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন বনি ইসরাইলকে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল যে, হত্যাকারী শনাক্ত করতে হলে যে কোনো প্রকারের এক গাভী জবাই করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু প্রকারান্তরে বনি ইসরাইল এ খোদায়ী নির্দেশ অমান্য করে নতুন নতুন প্রশ্ন করতে থাকে যা তাদের পক্ষে উচিত ছিল না। ফলে আল্লাহও বিষয়টি কঠিন করেছেন, এ জটিলতা তারা ডেকে এনেছিল। 

আলোচ্য ইসতিকমা কি তা সহজে অনুধাবন করার জন্য উদাহরণ স্বরূপ হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজের (রা.) একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার খলিফা দ্বিতীয় উমর তার একজন গভর্নরকে লিখলেন যে, আমি যখন তোমাকে নির্দেশ করবো যে, একটি বকরি দান করে দাও, তখন তুমি জিজ্ঞাসা করবে ‘যান’ অথবা মায দান করব? আমি যদি তাও বলে দেই, তখন তুমি প্রশ্ন করবে পুরুষ না মাদী? আমি যদি তাও বলে দেই তখন তুমি জানতে চাইবে কালো বকরি দান করবো, নাকি সাদা? সুতরাং আমি যখন কোনো বিষয়ের নির্দেশ দান করব তার পুনরাবৃত্তি করবে না।অপর একজন খলিফার ঘটনাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি একজন শাসককে লিখলেন যে, অমুক সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে তাদের বৃক্ষগুলো কর্তন করে ফেলো এবং তাদের বাড়িঘরসমূহ ধ্বংস করে দাও। তখন শাসক লিখলেন, ঘরবাড়ি ও বৃক্ষগুলোর মধ্যে কোন কাজটি প্রথমে করব? খলিফা জবাবে জানালেন, আমি যদি তোমাকে নির্দেশ দান করি যে, বৃক্ষগুলো হতে কাজের সূচনা কর তা হলে তুমি জিজ্ঞাসা করবে কোন প্রকারের বৃক্ষগুলো হতে কাজের সূচনা করব?গাভীটির রঙ-বর্ণ কি ছিল সে সম্পর্কে বর্ণনাকারী উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গাভীটির রঙ ছিল গভীর গাঢ় হলদে। হযরত কাতাদা (রা.)-এর মতে তা ছাফ, স্বচ্ছ, পরিষ্কার রঙের ছিল এবং হযরত ইমাম হাসান বসরী (রহ.)-এর মত অনুসারে গাভীটি হলদে ঈষৎ কালো রঙ বিশিষ্ট ছিল। তবে প্রথমোক্ত মত অধিক সঠিক বলে গণ্য করা, যা কোরআনে বর্ণিত রঙের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।লোকেরা যখন গাভীটি জবাই করে তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ আসে, জবাইকৃত গাভীর একটি অংশ দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করতে। এ অংশ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও সকল ভাষ্যকারের মতে, সে অংশটি হাঁড় যা নরম হাঁড় নামে পরিচিত। যেমন নাক, কান ইত্যাদি, মোজাহেদ এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের প্রমুখের মতে, ঐ অংশটি ছিল লেজের মূল। কেননা সর্বপ্রথম লেজের মূলকে সৃষ্টি করা হয়। জেহাক বলেন, অংশটি জবান বা জিব। কেননা এটিই হচ্ছে বাকযন্ত্র। আকরানা ও কালবী বলেন, ডান রান দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, কোনো নির্দিষ্ট অংশ ছিল না, লোকেরা জবাইকৃত গাভীর গোশত দ্বারা নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করা মাত্র নিহত ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে যায় এবং বলে দেয় যে, অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এতটুকু বলার পর সে মৃত হয়ে পড়ে যায়। সুতরাং তার হত্যাকারী কে তা জানা হয়ে যায়, বলা হয়ে থাকে, এ ঘটনার পর কোনো হত্যাকারী মিরাসের অধিকারী হয়নি। গো পূজারীদের প্রতি এ নির্দেশ কেন?বনি ইসরাইল ছিল গোপূজারী, গোভক্ত। হজরত মুসা (আ.) যখন তার ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে তুর পর্বতে গমন করেন তখন সামেরী একটি গোবাছুর বানিয়ে তার পূজা করার জন্য বনি ইসলাইলকে প্ররোচিত করেছিল। বলা হয়ে থাকে, তখন থেকে এ জাতি গোপূজার অনুসারী ও গোভক্ত হয়ে পড়ে এবং বিশেষভাবে গাভীর হত্যাকে ওরা পাপ মনে করতে থাকে। বনি ইসলাইলের গোপ্রীতি, ভক্তি ও গোপূজার বর্ণনা তাদের তওরাত গ্রন্থেও দেখা যায়। সুরা বাকারায় বর্ণিত বনি ইসরাইলের নিহত ব্যক্তি আমিলের ঘটনা সম্পর্কে হত্যাকারী শনাক্ত করার ব্যাপারে গরু জবাইয়ের নির্দেশ ব্যাপক আলোচিত বিষয়। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদির বর্ণনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার বিখ্যাত তফসীরে মাজেদীতে তিনি লিখেছেন : (অনুবাদ : এটি ছিল সেই সময় যখন দীর্ঘকাল মিশরে ও মিশরবাসীদের মাঝে অবস্থানের কারণে তাওহীদের পতাকাবাহী ইসরাইলীদের মধ্যেও অনেক অংশবাদী রীতি-প্রথার প্রসার ঘটেছিল এবং গরুর মাহাত্ম্য ও তার পবিত্র হওয়ার ধ্যান-ধারণা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ভারতের ন্যায় মিশরেও গোমাহাত্ম্য পৌত্তলিক (অংশীবাদী) ধর্মের অংশ বিশেষ ছিল। তাওরাতে ইহুদিদের প্রতি বিভিন্ন শর্ত ও বন্ধনযুক্ত গরু জবাইয়ের আদেশ বারবার প্রদান করা হয়েছে। যথা ইসরাইল সন্তানগণকে বলে, তারা নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক জোয়াল বহন করে নাই এমন এক রক্তবর্ণা গাভী তোমার নিকট আনুক। পরে তোমরা ইলীয়াসার (আল-যাসার) যাযককে সে গাভী দেবে এবং সে তাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে এবং তার সম্মুখে তাকে হনন করা হবে। গণনা পুস্তক (১৯:২, ৩)।যে নগরে নিহত লোকদের নিকটস্থ হবে, তথাকার পাল হতে এমন একটি গো-বৎসা নেবে যা দ্বারা কোনো কার্য হয়নি। যে জোয়াল বহন করেনি। পরে সেই গো-বৎসাকে এমন একটি উপত্যকায় আনবে, যেখানে (জল¯্রােত নিত্য বয়ে যায় এবং) চাষ বা বীজবপন করা হয় না, সে উপত্যকায় তার গ্রীবা ভেঙে ফেলবে (দ্বিতীয় বিবরণ ২১:৩, ৪) (তফসীরে মাজেদি পৃ. ১৩২)।তওরাতের উদ্ধৃত বিবরণ প্রমাণ করে যে, ইহুদীরা গো-পূজা করত এবং নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী শনাক্ত করতে হলেও পরে বর্ণিত গুণাবলীর একটি গাভী হত্যা করত তাদের জাহেলী আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারায় বর্ণিত নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী শনাক্ত করার জন্য গাভী জবাই করার নির্দেশ প্রদান করেন যার গুণাবলীর কথা আয়াতগুলোতেই রয়েছে।ঘটনাটি কার সম্পর্ক অধিকাংশের মতে, বনি ইসরাইলের ধনী ব্যক্তি আমিল নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও রয়েছে। আমরা আমিলের ঘটনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। তবে ভিন্ন মতগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তির এক অতি সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তার কোনো আত্মীয় মহিলার প্রতি আকৃষ্ট ছিল এবং তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিল। এ কারণে সে তার স্বামীকে হত্যা করে। হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকার কারণে গাভী জবাই করার নির্দেশ আসে। সকল আহরে ইসলামের মতে, নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয়। কেউ কেউ বলেন, হত্যাকারী ভীত হয়ে তার অপরাধ স্বীকার। অর্থাৎ হত্যার আত্মস্বীকারোক্তি করে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে আরেকটি মত হচ্ছে, বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির কন্যা বিয়ে করার প্রস্তাব পেশ করলে কন্যার পিতা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। এতে প্রস্তাবকারী ক্ষিপ্ত হয়ে কন্যার পিতাকে হত্যা করে। বাকি ঘটনার বিবরণ পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে ।এসব ঘটনার মধ্যে কোনোটি সঠিক তা আল্লাহই ভালো জানেন। কোরআনে বনি ইসরাইলের অহেতুক-বেহুদা নানা প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ গাভী কোন বর্ণ ও গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, এ গাভীর সন্ধান পেতে তাদের চল্লিশটি বছর দারুণ হয়রানির মধ্যে থাকার পর সে গাভী অতি চড়া দামে মেলে এবং তা জবাই করে তার অংশবিশেষ দিয়ে নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করার সাথে সাথে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয় এবং আবার মৃত্যুবরণ করে।কোরআনের এ বিখ্যাত ঘটনার কারণে বলা হয়ে থাকে যে, সূরাটির নাম করা হয়েছে বাকারা; শব্দটির অর্থ হচ্ছে গাভী। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু গুরুত্বপূর্ণ মাসালার উদ্ভব হয়েছে। ফেকা শাস্ত্রের পরিভাষায় এরূপ ঘটনাকে আল কাসামাহ বলা হয়। যার অর্থ হচ্ছে, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকলে, তার নাম-পরিচয় জানা না গেলে ইসলামের এ সম্পর্কে কি বিধান ও বিষয়টি নিয়ে ফেকার কিতাবগুলোতে বিশদ বিবরণ রয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত এই যে, অকুস্থলের আশপাশের তথা মহল্লাবাসীর সকলকে শপথ করে বলতে হবে যে, নিহতের হত্যাকারী সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। এরূপ খুনের ঘটনার ন্যায় গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনারও একই হুকুম বা বিধান। খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব না হলে সকল অভিযুক্তের কাছ থেকে শপথ নিতে হবে বলেও মত রয়েছে।সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট ভাষ্য ও অন্যান্য গ্রন্থের বিবরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছি। এসব গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ আরো বহু সূ² বিষয় জানা যায় বনি ইসরাইলের গাভী জবাই সংক্রান্ত তরিকা বা প্রথার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে যারা নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন মওলানা মোহাম্মদ হিফজুর রহমান সাহওয়ারভী (রা.) তা মানতে রাজি নন, তিনি এ মতকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে হাফেজ ইমাজদ্দীন ইবনে কামীরকে উদ্বুদ্ধ করে বলেন এবং ওবায়দা, আবুল আলিয়া এবং অন্যদের বর্ণিত ধারা বিবরণীগুলো পরস্পরবিরোধী এবং ছাফ সোজা কথা হচ্ছে এই যে, বনি ইসরাইলের গ্রন্থাবলী হতে গৃহীত এসব বর্ণনাকে স্বীকারও করি না, মিথ্যাও বলি নাÑ যা নকল করা জায়েজ বটে। এ কারণে ওসব বর্ণনার ওপর নিশ্চিতরূপে আস্থাশীল হওয়া যায় না তবে সে সব বর্ণনা কোরআন ও হাদীসের আলোকে অধিক সঠিক, সত্য, সেগুলো আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। তিনি আরো বলেন, যখন মুসলিমের হাদীসে মাত্র এতটুকু উল্লেখ আছে যে, বনি ইসরাইল যদি মুসা (আ.)-এর সাথে বাদানুবাদ না করত, তাহলে গাভীর ব্যাপারে তাদের প্রতি শর্তাবলী আরোপিত হতো না, তাহলে যদি এর চেয়ে অধিক অবস্থা ও ঘটনাবলিও তার সাথে সম্পৃক্ত হতো, তাহলে নবী মাসুম (স.) অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। (কাসাসুল কোরআন প্রথম খ. পৃ. ৩৮৯-৭০)। (সমাপ্ত) - সূত্র - কেএস সিদ্দিকী : দৈনিক েইনকিলাব