ইসলামে মায়ের
সম্মান
ও
অধিকার
পৃথিবীতে সবচেয়ে
প্রিয় এবং মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দুঃখে-কষ্টে,
বিপদে-সংকটে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেন, তিনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন,
মা। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা একমাত্র মায়ের।
মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক, যা একটু
আঘাত পেলেই প্রতিটি মানুষ 'মা' বলে চিৎকার দিয়ে জানান দিয়ে থাকে।
একদিন হজরত মুয়াবিয়া
ইবনে জাহিমা আসসালামী (রা.) রাসুল (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বললেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ!
আমি জিহাদ করতে ইচ্ছুুক। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?' জবাবে রাসুল (সা.) বললেন,
'তোমার মা আছেন?' তিনি বললেন, 'আছেন। ' রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'মায়ের সেবায় নিয়োজিত
থাকো, কেননা তাঁর পায়ের নিচেই জান্নাত।
ইসলাম
মাতা-পিতাকে সর্বোচ্চ অধিকার
ও সম্মান দিয়েছে।
ইসলামের বিধানমতে, আল্লাহ তাআলার পরেই
মাতা-পিতার স্থান।
এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা
হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ
দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য
কারও ইবাদত না করতে
এবং মাতা-পিতার সঙ্গে
সদ্ব্যবহার করতে। তাঁদের
একজন অথবা উভয়ে তোমার
জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের
উফ্ (বিরক্তিও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না
এবং তাঁদের ধমক দেবে
না; তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক
কথা বলবে। মমতাবশে
তাঁদের প্রতি নম্রতার ডানা
প্রসারিত করো এবং বলো,
“হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের
প্রতি দয়া করো, যেভাবে
শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন
করেছেন।”’ (সুরা-১৭ ইসরা-বনি
ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)।
আল্লাহ
তাআলা পবিত্র কোরআনের অন্যত্র
ঘোষণা করেন, ‘আমি তো
মানুষকে তার পিতা-মাতার
প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী
সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট
করে গর্ভে ধারণ করেন
এবং তার দুধ ছাড়ানো
হয় দুই বছরে; সুতরাং
আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার
পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ
হও। প্রত্যাবর্তন
তো আমারই কাছে।’
(সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত:
১৪)। ‘আর
আমি (আল্লাহ) মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন
তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে
সুন্দর আচরণ করে; তার
মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে
ধারণ করেছেন ও অতিকষ্টে
প্রসব করেছেন এবং লালন-পালন করেছেন।’
(সুরা-৪৬ আহকাফ, আয়াত:
১৫)। আরও
বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর
ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে
কাউকে শরিক কোরো না
এবং পিতা-মাতার সঙ্গে
সুন্দর আচরণ করো।’
(সুরা-৪ নিসা, আয়াত:
৩৬)।
উল্লিখিত
আয়াতগুলোতে স্পষ্ট ভাষায় বলা
হয়েছে, আল্লাহর পরেই মা-বাবার
অধিকার। সেই
অধিকার কীভাবে আদায় করতে
হবে, সেটাও বলা হয়েছে। পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে
হাদিসে বহু জায়গায় বর্ণনা
এসেছে। হজরত
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, এক ব্যক্তি
রাসুল (সা.)-এর কাছে
এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর
রাসুল! কে আমার উত্তম
আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার?’
তিনি বললেন ‘তোমার মা’;
সে বলল, ‘তারপর কে?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা’; সে
আবারও বলল, ‘তারপর কে?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা’।
সে পুনরায় বলল, ‘এরপর
কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার
পিতা’। (বুখারি
শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। প্রিয়
নবী (সা.) আরও এরশাদ
করেন, ‘জান্নাত মায়ের পদতলে’।
(মুসলিম)
মাতা-পিতার খেদমত না
করার কারণে যারা জান্নাত
থেকে বঞ্চিত হলো, রাসুল
(সা.) তাদের অভিসম্পাত দিয়েছেন। হাদিস
শরিফে এসেছে—একদা জুমার
দিনে রাসুল (সা.) মিম্বারের
প্রথম ধাপে পা রাখলেন
এবং বললেন, আমিন! অতঃপর
দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন
এবং বললেন, আমিন! তার
পর তৃতীয় ধাপে পা
রাখলেন এবং বললেন, আমিন!
এরপর খুতবাহ দিলেন ও
নামাজ আদায় করলেন।
নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম
প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.),
আজ যা দেখলাম তা
এর আগে কখনো দেখিনি
(আপনি একেক ধাপে পা
রেখে আমিন! আমিন!! আমিন!!
বললেন); এটা কি কোনো
নতুন নিয়ম নাকি?’
নবী করিম (সা.) বললেন:
না, এটা নতুন কোনো
নিয়ম নয়; বরং আমি
মিম্বারে ওঠার সময় হজরত
জিবরাইল (আ.) এলেন, আমি
যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা
রাখি, তখন হজরত জিবরাইল
(আ.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
যারা পিতা-মাতা উভয়কে
বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায়
পেয়েও তাঁদের খেদমতের মাধ্যমে
জান্নাত অর্জন করতে পারল
না, তারা ধ্বংস হোক।’ তখন
আমি {রাসুল (সা.)} সম্মতি
জানিয়ে বললাম, আমিন! (তা-ই হোক)।
আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয়
ধাপে পা রাখি, তখন
তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
যারা রমজান পেল কিন্তু
ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ
করাতে পারল না, তারা
ধ্বংস হোক।’ তখন
আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম,
আমিন! আমি যখন মিম্বারের
তৃতীয় ধাপে পা রাখি,
তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ
তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র
নাম মোবারক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনল,
কিন্তু দরুদ (নবীজির প্রতি
শুভকামনা) শরিফ পাঠ করল
না, তারা ধ্বংস হোক।’ তখন
আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম,
আমিন!
নবজাতক
হজরত ঈসা (আ.)-এর
মুখে মহান রাব্বুল আলামিন
আল্লাহ তাআলা ভাষা ফুটিয়ে
দিলেন; তখন তিনি বলেছিলেন,
‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা,
আমাকে কিতাব (আসমানি গ্রন্থ
ইঞ্জিল) দেওয়া হয়েছে এবং
তিনি (আল্লাহ) আমাকে নবী করেছেন। আর
আমাকে বরকতময় করা হয়েছে
আমি যেখানেই থাকব; আর আমাকে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সালাত
ও জাকাত বিষয়ে, যত
দিন আমি জীবিত থাকব।’ হজরত
ঈসা (আ.) আরও বলেন,
‘আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে, আমি যেন আমার
মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করি
(অনুগত ও বাধ্য থাকি);
আমাকে করা হয়নি উদ্ধত
অবাধ্য ও দুর্ভাগা হতভাগ্য।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত:
৩০-৩২)।
বনি ইসরাইলের নবী হজরত মুসা
(আ.)-এর প্রতিও এ
বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর
আমি বনি ইসরাইল থেকে
এই অঙ্গীকার নিয়েছি যে তোমরা
আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত
করবে না, পিতা-মাতার
সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত:
৮৩)।
পিতা-মাতা সন্তানের সম্পদের
অধিকারী ও উত্তরাধিকারী।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা
বলেন: ‘আর পিতা-মাতা
উভয়ের প্রত্যেকের জন্য (সন্তানের) সম্পদের
এক–ষষ্ঠাংশ যদি তার সন্তান
থাকে; আর যদি সন্তান
না থাকে, তবে পিতা-মাতাই ওয়ারিশ বা
উত্তরাধিকারী হবেন, এমতাবস্থায় তার
মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত:
১১)।
রাসুল
(সা.)-এর জমানায় বিখ্যাত
এক আশেকে রাসুলের ঘটনা
আমরা জানি। যিনি
প্রিয় নবীজি (সা.)-কে
দেখেননি। সেই
আশেকে রাসুলের নাম হজরত ওয়াইস
আল করনি (রা.)।
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর
জমানায় থেকেও তিনি সাহাবি
হতে পারেননি মায়ের সেবা করার
কারণে। তবে
এতে করে তাঁর মর্যাদা
কমেনি; বরং তিনি সম্মানিত
হয়েছেন। একবার
ওয়াইস করনি (রা.) প্রিয়
নবীজির কাছে এই মর্মে
খবর পাঠালেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.),
আপনার সঙ্গে আমার দেখা
করতে মন চায়; কিন্তু
আমার মা অসুস্থ।
এখন আমি কী করতে
পারি?’ নবীজি (সা.) উত্তর
পাঠালেন, ‘আমার কাছে আসতে
হবে না। আমার
সাক্ষাতের চেয়ে তোমার মায়ের
খেদমত করা বেশি জরুরি
ও বেশি ফজিলতের কাজ।’ শুধু
তা-ই নয়, নবীজি
(সা.) তাঁর গায়ের একটি
জুব্বা তার জন্য রেখে
যান এবং বলেন, ‘মায়ের
খেদমতের কারণে সে আমার
কাছে আসতে পারেনি; আমার
ইন্তেকালের পর আমার এ
জুব্বাটি তাকে উপহার দেবে।’ নবীজি
(সা.) জুব্বাটি রেখে যান হজরত
ওমর (রা.)-এর কাছে
এবং তিনি বলেন, ‘হে
ওমর! ওয়াইস আল করনির
কাছ থেকে তুমি দোয়া
নিয়ো।’ সুবহানাল্লাহ!
আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন
আমাদের ওয়াইস করনির মতো
মায়ের সেবা ও খেদমত
করার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর
রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দিন।
আমিন!
মুফতি মাওলানা শাঈখ
মুহাম্মাদ
উছমান
গনী:
যুগ্ম
মহাসচিব,
বাংলাদেশ
জাতীয়
ইমাম
সমিতি,
সহকারী অধ্যাপক,
আহ্ছানিয়া
ইনস্টিটিউট
অব
সুফিজম।
0 comments:
Post a Comment