হালাল-উপার্জন উত্তম ইবাদত
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শুক্রবার, ৮:২৯
ইসলামে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা একটি উত্তম কাজ। ব্যবসায় করা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। এই পৃথিবীতে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত বহু নবী-রাসূল ব্যবসায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবে-তাবেইন, আউলিয়া কেরামেরা ব্যবসায় করেছেন। আমাদের হানাফি মাজহাবের ইমাম হজরত ইমাম আবু হানিফাও র: একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায় করা হালাল। ইবাদতের দশ ভাগের নয় ভাগ হালাল খাদ্যের মধ্যে নিহিত। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় হালাল (বৈধ) করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। হজরত রাফে বিন খাদিজ রা: থেকে বর্ণিত একদা জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা:। কোন প্রকার উপার্জন উত্তম? তিনি বললেন, ‘মানুষের দুই হাতের কাজ ও হালাল ব্যবসায় উপার্জন’ (আহমদ, মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪১)।
হালাল ব্যবসায়-বাণিজ্যের মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর দ্বারা সহজেই আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করা যায়। তবে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু আচরণবিধি আছে। তা মেনে ব্যবসায় করলেই সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছা সম্ভব। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক ব্যবসায় করার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং তা করার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছে। প্রয়োজনে এ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের জন্য উৎসাহ দিয়েছে এবং এ কাজকে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান বলেছেন। উপরন্তু ব্যবসায়ের জন্য যারা বিদেশ সফর করেন তাদের আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে বিদেশ সফর করবে এবং অপর কিছু লোক আল্লাহর পথে জেহাদ করবে’ (সূরা মুজাম্মিল : ২০)।
আমাদের প্রিয়নবী সা: ব্যবসায় করেছেন। তিনি যে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই মক্কা শহর সমগ্র আরব উপদ্বীপের মধ্যে একটি বিশেষ ও বিশিষ্ট ধরনের ব্যবসায় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হজরত ইবরাহিম আ: দোয়া করেছিলেন, ‘অতএব, হে আল্লাহ আপনি লোকদের মনকে তাদের প্রতি আগ্রহী বানিয়ে দিন এবং তাদের রিজিক দিন নানা প্রকার ফলমূল দিয়ে, যেন তারা শোকর করতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)।
এ দোয়াও মক্কাবাসীর জন্য খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে কুরাইশদের প্রতিও আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করেছিলেন ‘ইয়ামেনমুখী শীতকালীন ব্যবসায় সফর এবং সিরিয়ামুখী গ্রীষ্মকালীন ব্যবসায় সফরে সুষ্ঠু এ নিরাপদ ব্যবস্থা করে দিয়ে। আর তাদের এ সফরকালীন নিরাপত্তা ছিল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং তা করা হয়েছিল এ জন্য যে, তারা কাবাঘরের খেদমত করত।
পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি হাদিস শরিফে প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপারে বিপুলভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। এ বিষয়টি তাঁর কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথমত যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো মূলধন। ব্যবসায় যেহেতু হালাল, অতএব এর মূলধনও হতে হবে হালাল বা পবিত্র। যিনি ব্যবসায় করবেন তার নিয়ত থাকতে হবে ভালো। ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা হচ্ছে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারণ সততা বা সত্যবাদিতার দ্বারাই একজন ব্যবসায়ী কাক্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সা: এরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী, আমানতদার, বিশ্বাসী ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে থাকবেন’ (তিরমিজি, মিশকাত, পৃষ্ঠা. ২৪৩)।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় অতিরিক্ত কথা বলা হয়, পণ্য বিক্রির জন্য আবার মিথ্যা কসম করা হয়। এসব কিছু পরিহার করতে হবে। প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়ীদের প্রতি লক্ষ করে বলেছেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! ব্যবসায় বেহুদা কথা এবং নিষ্প্রয়োজন কসম করা হয়ে থাকে (যা গুনাহ বলে পরিগণিত হয় তার প্রায়শ্চিত্তে)। তোমরা ব্যবসায় করার সাথে সাথে সদকা করো’ (আবু দাউদ, মিশকাত- পৃষ্ঠা: ২৪৩)।
হালাল ব্যবসার ক্ষেত্রে ধোঁকাবাজি বিরাট প্রতিবন্ধক। অনেকে ব্যবসায় ক্রেতার সাথে ধোঁকাবাজি বা মারাত্মক প্রতারণা করে থাকে, যা আদৌ উচিত নয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, ‘একদা প্রিয়নবী সা: (বিক্রয়ের জন্য স্তূপীকৃত) খাদ্যদ্রব্যের এক স্তূপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার ভেতর হাত ঢুকালেন। অতঃপর তাঁর আঙুল ভিজে গেল। তিনি খাদ্যের মালিককে বললেন, একি? সে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল। প্রিয়নবী (সা:) বললেন, ভিজাগুলোকে খাদ্যের উপরিভাগে কেন রাখলে না? যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়। অতঃপর প্রিয়নবী সা: বললেন, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’ (মুসলিম, মিশকাত- পৃষ্ঠা: ২৪৮)।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিক্রেতা ত্রুটিযুক্ত মাল না বলে ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। এটাও একধরনের অন্যায় এবং বিরাট প্রতারণা। হজরত ওয়াসিলা বিন আসকা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবী সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কোনো ত্রুটিযুক্ত বস্তুকে এর ত্রুটি না জানিয়ে বিক্রি করবে সে সর্বদা আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে নিমজ্জিত থাকবে অথবা বলেছেন, সর্বদা তার প্রতি ফেরেশতাগণ অভিশাপ করবেন’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, পৃষ্ঠা: ২৪৯)। অনেকে পার্টনারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে উভয়েরই খেয়াল রাখতে হবে যাতে কারো দ্বারা আমানতের খেয়ানত না হয়। কারণ খেয়ানত করা কবিরা গুনাহ। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, প্রিয়নবী সা: এরশাদ করেছেন, ‘ব্যবসায়-বাণিজ্যে দুই শরিকের বা অংশীদারের কোন একজন যে পর্যন্ত খেয়ানতে লিপ্ত না হয় সে পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গেই অবস্থান করি। কিন্তু তাদের কেউ যখন খেয়ানত শুরু করে, তখন আমি তাদের পরিত্যাগ করি। অন্য এক বর্ণনা মতে, তখন তাদের মাঝখানে শয়তান এসে যায়’ (আবু দাউদ)। প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে মুজাহিদ ও শহীদদের সমান মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, জিহাদ কেবলমাত্র যুদ্ধের ময়দানেই অনুষ্ঠিত হয় না, বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই জিহাদ অবশ্যম্ভাবী।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রিয়নবী সা:-এর কর্মনীতিই যথেষ্ট। তিনি যেমন আধ্যাত্মিক দিকের প্রতি পূর্ণমাত্রায় গুরুত্বারোপ করেছেন, তেমনি মদিনায় তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য খালেস বাজার সৃষ্টি করেছিলেন, যার ওপর অন্য কারো কোনো কর্তৃত্ব বা আধিপত্য ছিল না। পূর্ব থেকে চলে আসা ‘বনু কায়নুকা’ বাজার ইহুদিদেরই কর্তৃত্বাধীন ছিল। প্রিয়নবী সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজারের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-কানুন নিজেই প্রচলন করেছিলেন এবং নিজেই দেখাশোনা করতেন। এ বাজারটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সেখানে কোনো প্রকার ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকাঠকির কারবার বা মাপে-ওজনে কম-বেশি অথবা পণ্যদ্রব্য আটক করে লোকদের কষ্ট দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। প্রিয়নবীর সা: সাহাবিদের মধ্যে বেশির ভাগ আনসার কৃষিকাজ করতেন। আর মুহাজিররা সাধারণত ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। এমনই একজন মহান সাহাবি হলেন হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা:। তিনি মুহাজির ছিলেন। তার দ্বীনি ভাই সাদ ইবনে আনসারী রা: তাকে তার অর্ধেক সম্পদ, দু’টি বাড়ির একটি এবং দু’জন স্ত্রীর মধ্য থেকে একজন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার কাছে বিবাহ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এ বিরাট ত্যাগের জবাবে অনুরূপ বিরাট আত্মসম্মন বোধ দেখালেন। তিনি সাদকে বললেন, আল্লাহ আপনার ধনসম্পদ ও পরিবার পরিজনে বরকত দিন, আমার ওসবের দরকার নেই। এখানে ব্যবসায় করার জন্য কোনো বাজার থাকলে আমাকে দেখিয়ে দিন, আমি ব্যবসায় করব। হজরত সাদ রা: তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিলেন। পরের দিন তিনি পনির ও ঘিসহ বাজারে গিয়ে তা বিক্রি করেন। তিনি এ ব্যবসায় করে প্রচুর সম্পদ উপার্জন করেন। মৃত্যুর সময় তিনি এক বিপুল বিত্ত-বৈভব রেখে গিয়েছিলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:-এর দৃষ্টান্ত আরোও ভাস্বর। তিনি বরাবর ব্যবসাই করেছেন। এ জন্য প্রাণপণ খাটাখাটুনি করতেন। এমনকি খলিফা নির্বাচিত হওয়ার দিনও তিনি বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন।
ইসলামে ব্যবসায় হারাম নয়, তবে যে ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফাখোরী কিংবা কোনো কোনো নিষিদ্ধ জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন হয় তা নিশ্চয়ই হারাম। সুদি ব্যবসায় করা চলবে না। কেননা সুদকে-সুদি কারবারলব্ধ মুনাফাকে আল্লাহ তায়ালা নির্মূল করে দেন। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কোনো লোক যদি সুদের একটি দিরহামও জেনেশুনে খায় তবে তা ৩৬ বার জেনা করার চেয়েও বড় গুনাহ।’ (আহমদ)। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা যদি ব্যবসায়-বাণিজ্যের আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে ব্যবসায় করেন তাহলে একটি উন্নত জাতি গঠন করা সহজ হবে সন্দেহাতীতভাবে।
মাওলানা বায়েজীদ হোসাইন সালেহ: খতিব, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র:) জামে মসজিদ, ঢাকা।
সূত্র - দৈনিক নয়াদিগন্ত।
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শুক্রবার, ৮:২৯
ইসলামে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা একটি উত্তম কাজ। ব্যবসায় করা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। এই পৃথিবীতে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত বহু নবী-রাসূল ব্যবসায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবে-তাবেইন, আউলিয়া কেরামেরা ব্যবসায় করেছেন। আমাদের হানাফি মাজহাবের ইমাম হজরত ইমাম আবু হানিফাও র: একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায় করা হালাল। ইবাদতের দশ ভাগের নয় ভাগ হালাল খাদ্যের মধ্যে নিহিত। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় হালাল (বৈধ) করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। হজরত রাফে বিন খাদিজ রা: থেকে বর্ণিত একদা জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা:। কোন প্রকার উপার্জন উত্তম? তিনি বললেন, ‘মানুষের দুই হাতের কাজ ও হালাল ব্যবসায় উপার্জন’ (আহমদ, মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪১)।
হালাল ব্যবসায়-বাণিজ্যের মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর দ্বারা সহজেই আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করা যায়। তবে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু আচরণবিধি আছে। তা মেনে ব্যবসায় করলেই সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছা সম্ভব। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক ব্যবসায় করার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং তা করার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছে। প্রয়োজনে এ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের জন্য উৎসাহ দিয়েছে এবং এ কাজকে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান বলেছেন। উপরন্তু ব্যবসায়ের জন্য যারা বিদেশ সফর করেন তাদের আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে বিদেশ সফর করবে এবং অপর কিছু লোক আল্লাহর পথে জেহাদ করবে’ (সূরা মুজাম্মিল : ২০)।
আমাদের প্রিয়নবী সা: ব্যবসায় করেছেন। তিনি যে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই মক্কা শহর সমগ্র আরব উপদ্বীপের মধ্যে একটি বিশেষ ও বিশিষ্ট ধরনের ব্যবসায় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হজরত ইবরাহিম আ: দোয়া করেছিলেন, ‘অতএব, হে আল্লাহ আপনি লোকদের মনকে তাদের প্রতি আগ্রহী বানিয়ে দিন এবং তাদের রিজিক দিন নানা প্রকার ফলমূল দিয়ে, যেন তারা শোকর করতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)।
এ দোয়াও মক্কাবাসীর জন্য খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে কুরাইশদের প্রতিও আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করেছিলেন ‘ইয়ামেনমুখী শীতকালীন ব্যবসায় সফর এবং সিরিয়ামুখী গ্রীষ্মকালীন ব্যবসায় সফরে সুষ্ঠু এ নিরাপদ ব্যবস্থা করে দিয়ে। আর তাদের এ সফরকালীন নিরাপত্তা ছিল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং তা করা হয়েছিল এ জন্য যে, তারা কাবাঘরের খেদমত করত।
পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি হাদিস শরিফে প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপারে বিপুলভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। এ বিষয়টি তাঁর কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথমত যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো মূলধন। ব্যবসায় যেহেতু হালাল, অতএব এর মূলধনও হতে হবে হালাল বা পবিত্র। যিনি ব্যবসায় করবেন তার নিয়ত থাকতে হবে ভালো। ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা হচ্ছে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারণ সততা বা সত্যবাদিতার দ্বারাই একজন ব্যবসায়ী কাক্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সা: এরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী, আমানতদার, বিশ্বাসী ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে থাকবেন’ (তিরমিজি, মিশকাত, পৃষ্ঠা. ২৪৩)।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় অতিরিক্ত কথা বলা হয়, পণ্য বিক্রির জন্য আবার মিথ্যা কসম করা হয়। এসব কিছু পরিহার করতে হবে। প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়ীদের প্রতি লক্ষ করে বলেছেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! ব্যবসায় বেহুদা কথা এবং নিষ্প্রয়োজন কসম করা হয়ে থাকে (যা গুনাহ বলে পরিগণিত হয় তার প্রায়শ্চিত্তে)। তোমরা ব্যবসায় করার সাথে সাথে সদকা করো’ (আবু দাউদ, মিশকাত- পৃষ্ঠা: ২৪৩)।
হালাল ব্যবসার ক্ষেত্রে ধোঁকাবাজি বিরাট প্রতিবন্ধক। অনেকে ব্যবসায় ক্রেতার সাথে ধোঁকাবাজি বা মারাত্মক প্রতারণা করে থাকে, যা আদৌ উচিত নয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, ‘একদা প্রিয়নবী সা: (বিক্রয়ের জন্য স্তূপীকৃত) খাদ্যদ্রব্যের এক স্তূপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার ভেতর হাত ঢুকালেন। অতঃপর তাঁর আঙুল ভিজে গেল। তিনি খাদ্যের মালিককে বললেন, একি? সে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল। প্রিয়নবী (সা:) বললেন, ভিজাগুলোকে খাদ্যের উপরিভাগে কেন রাখলে না? যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়। অতঃপর প্রিয়নবী সা: বললেন, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’ (মুসলিম, মিশকাত- পৃষ্ঠা: ২৪৮)।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিক্রেতা ত্রুটিযুক্ত মাল না বলে ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। এটাও একধরনের অন্যায় এবং বিরাট প্রতারণা। হজরত ওয়াসিলা বিন আসকা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবী সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কোনো ত্রুটিযুক্ত বস্তুকে এর ত্রুটি না জানিয়ে বিক্রি করবে সে সর্বদা আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে নিমজ্জিত থাকবে অথবা বলেছেন, সর্বদা তার প্রতি ফেরেশতাগণ অভিশাপ করবেন’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, পৃষ্ঠা: ২৪৯)। অনেকে পার্টনারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে উভয়েরই খেয়াল রাখতে হবে যাতে কারো দ্বারা আমানতের খেয়ানত না হয়। কারণ খেয়ানত করা কবিরা গুনাহ। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, প্রিয়নবী সা: এরশাদ করেছেন, ‘ব্যবসায়-বাণিজ্যে দুই শরিকের বা অংশীদারের কোন একজন যে পর্যন্ত খেয়ানতে লিপ্ত না হয় সে পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গেই অবস্থান করি। কিন্তু তাদের কেউ যখন খেয়ানত শুরু করে, তখন আমি তাদের পরিত্যাগ করি। অন্য এক বর্ণনা মতে, তখন তাদের মাঝখানে শয়তান এসে যায়’ (আবু দাউদ)। প্রিয়নবী সা: ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে মুজাহিদ ও শহীদদের সমান মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, জিহাদ কেবলমাত্র যুদ্ধের ময়দানেই অনুষ্ঠিত হয় না, বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই জিহাদ অবশ্যম্ভাবী।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রিয়নবী সা:-এর কর্মনীতিই যথেষ্ট। তিনি যেমন আধ্যাত্মিক দিকের প্রতি পূর্ণমাত্রায় গুরুত্বারোপ করেছেন, তেমনি মদিনায় তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য খালেস বাজার সৃষ্টি করেছিলেন, যার ওপর অন্য কারো কোনো কর্তৃত্ব বা আধিপত্য ছিল না। পূর্ব থেকে চলে আসা ‘বনু কায়নুকা’ বাজার ইহুদিদেরই কর্তৃত্বাধীন ছিল। প্রিয়নবী সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজারের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-কানুন নিজেই প্রচলন করেছিলেন এবং নিজেই দেখাশোনা করতেন। এ বাজারটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সেখানে কোনো প্রকার ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকাঠকির কারবার বা মাপে-ওজনে কম-বেশি অথবা পণ্যদ্রব্য আটক করে লোকদের কষ্ট দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। প্রিয়নবীর সা: সাহাবিদের মধ্যে বেশির ভাগ আনসার কৃষিকাজ করতেন। আর মুহাজিররা সাধারণত ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। এমনই একজন মহান সাহাবি হলেন হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা:। তিনি মুহাজির ছিলেন। তার দ্বীনি ভাই সাদ ইবনে আনসারী রা: তাকে তার অর্ধেক সম্পদ, দু’টি বাড়ির একটি এবং দু’জন স্ত্রীর মধ্য থেকে একজন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার কাছে বিবাহ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এ বিরাট ত্যাগের জবাবে অনুরূপ বিরাট আত্মসম্মন বোধ দেখালেন। তিনি সাদকে বললেন, আল্লাহ আপনার ধনসম্পদ ও পরিবার পরিজনে বরকত দিন, আমার ওসবের দরকার নেই। এখানে ব্যবসায় করার জন্য কোনো বাজার থাকলে আমাকে দেখিয়ে দিন, আমি ব্যবসায় করব। হজরত সাদ রা: তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিলেন। পরের দিন তিনি পনির ও ঘিসহ বাজারে গিয়ে তা বিক্রি করেন। তিনি এ ব্যবসায় করে প্রচুর সম্পদ উপার্জন করেন। মৃত্যুর সময় তিনি এক বিপুল বিত্ত-বৈভব রেখে গিয়েছিলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:-এর দৃষ্টান্ত আরোও ভাস্বর। তিনি বরাবর ব্যবসাই করেছেন। এ জন্য প্রাণপণ খাটাখাটুনি করতেন। এমনকি খলিফা নির্বাচিত হওয়ার দিনও তিনি বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন।
ইসলামে ব্যবসায় হারাম নয়, তবে যে ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফাখোরী কিংবা কোনো কোনো নিষিদ্ধ জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন হয় তা নিশ্চয়ই হারাম। সুদি ব্যবসায় করা চলবে না। কেননা সুদকে-সুদি কারবারলব্ধ মুনাফাকে আল্লাহ তায়ালা নির্মূল করে দেন। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কোনো লোক যদি সুদের একটি দিরহামও জেনেশুনে খায় তবে তা ৩৬ বার জেনা করার চেয়েও বড় গুনাহ।’ (আহমদ)। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা যদি ব্যবসায়-বাণিজ্যের আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে ব্যবসায় করেন তাহলে একটি উন্নত জাতি গঠন করা সহজ হবে সন্দেহাতীতভাবে।
মাওলানা বায়েজীদ হোসাইন সালেহ: খতিব, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র:) জামে মসজিদ, ঢাকা।
সূত্র - দৈনিক নয়াদিগন্ত।
0 comments:
Post a Comment