দ্বীন প্রচারের মিশনে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা
২০১৪ সালের ইজতেমার ২য় পর্বের আখেরি মুনাজাতে মুসল্লিদের একাংশ
দ্বীন প্রচারের মেহনতে সময় ব্যয় করার মহান প্রত্যয় নিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাতের ৪৯তম বিশ্ব ইজতেমা। দেশ-বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত দিতে প্রায় ছয় হাজার জামাত ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করছে। নবী-রাসূলদের এ মহতী কাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবিই তাদের লক্ষ্য। দুই দফায় ছয় দিনের ইজতেমায় তাবলিগি কাজেরই দীক্ষা গ্রহণ করেছেন লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমান। শুধু ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেই নয়; তারা দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে চান সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। শ্বাশত ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে জড়ো করতে চান পথহারা লক্ষ্যভ্রষ্ট বিপথগামী মানুষদের। বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে কেবল নিজের পাপ মোচনের উদ্দেশে নেন না বরং তাবলিগের (দ্বীন প্রচারের) দীক্ষা নিতেই ইজতেমায় আসেন লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ইজতেমায় (সমাবেশে) তিন দিন অবস্থানের সুযোগে প্রতি ওয়াক্তে লাখো মুসল্লির কাতারে দাঁড়িয়ে বৃহত্তর জামাতে নামাজ পড়ার নেকি হাসিলের পাশাপাশি অন্যান্য ইবাদতেও সংখ্যাধিক্যের নেকি রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন তারা। এ দিকে আগামী বছর ২০১৫ সালে ইজতেমা শুরু হবে ৯ জানুয়ারি।
আখেরি মুনাজাত : উম্মতে মোহাম্মাদির মাগফিরাত, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ, নবী-রাসূল, সত্যবাদীদের সাথে হাশর-নশর ও জান্নাত কামনা, মুসলিম জাহানের মজবুতি ঈমান, দ্বীনের মেহনত, সুন্নতি জীবন, নামাজে খুসুখুজু তৈরি, দ্বীন ইসলামের হেফাজত, ইজতেমাকে কবুল, দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় অক্যাণ থেকে রা এবং কল্যাণ কামনা করে মহান আল্লøাহর দরবারে মুনাজাত করেন দাওয়াতে তাবলিগের অন্যতম শীর্ষ মুরুব্বি ভারতের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। আখেরি মুনাজাত শুরু হয় সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে। শেষ হয় ১০টা ১২ মিনিটে। ১৭ মিনিট স্থায়ী মুনাজাতে লাখো লাখো মুসল্লির অশ্রুসিক্ত নয়নে আমিন, আমিন ধ্বনিতে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। প্রথম পর্বের ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে ময়দানের বাইরে চারপাশের বিস্তৃর্ণ এলাকায় মাইক সংযোগ দেয়া হলেও দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাতে সেই ব্যবস্থা না থাকায় এবং দ্বিতীয় দফার আখেরি মুনাজাত নির্ধারিত সময়ের আগে ও সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ হওয়ায় লাখো মুসল্লি মুনাজাতে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হন। আখেরি মুনাজাত নিয়ে তুরাগ তীরসহ পুরো টঙ্গী ও আশপাশের এলাকা মুসল্লিদের পদচারাণায় মুখর হয়ে উঠে। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি সমৃদ্ধি কল্যাণ কামনা করে ভাবগম্ভীর পরিবেশে অশ্রুভেজা ফরিয়াদে লাখো হাতের আকুতিতে ময়দানে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। থেকে থেকে আমিন, ছুম্মা আমিন ধ্বনি সেই নীরবতাকে ভঙ্গ করে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আখেরি মুনাজাতের আগে দাওয়াতে মেহনতের ওপর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ।
আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগতীরসহ আশপাশের সব এলাকা। ভেতরে জায়গা না পেয়ে মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। একই সাথে বন্ধ হয়ে যায় আশুলিয়া ও নরসিংদী সড়ক। লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষের মিলনমেলায় তুরাগতীর বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। দলে দলে রাস্তায় মানুষের যাতায়াতের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকা-ময়মনিসংহ মহাসড়কের জয়দেবপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কে কোনো গণপরিবহন চলেনি। ইজতেমার কাজে নিয়োজিত ও সরকারি কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ছাড়া গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকে।
আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে গতকাল ভোর থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা অভিমুখে শুরু হয় মানুষের ঢল। টঙ্গীর পথে গতকাল ভোর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিং মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুনাজাতে অংশ নিতে চার দিক থেকে লাখো লাখো মুসুল্লি হেঁটে ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন।
আখেরি মুনাজাতের জন্য গতকাল আশপাশের শিাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মীদের মুনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। বিভিন্ন বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মুনাজাতে অংশ নিতে গতকাল সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন।
মুনাজাতে অংশ নিতে পারেননি লাখো মুসল্লি : নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই আখেরি মুনাজাত সম্পন্ন হওয়ায় লাখো মুসল্লি অংশ নিতে পারেননি এবারের দ্বিতীয় দফার ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে। এ ছাড়া ইজতেমা ময়দানের বাইরে অতিরিক্ত মাইক সংযোগ না থাকায় মুনাজাত শেষেও জনতার স্রোত ইজতেমা অভিমুখে যাচ্ছিল। মুনাজাত শেষে ময়দান ছেড়ে দলে দলে মানুষ যখন গন্তব্যে যাচ্ছিলেন তখনো অসংখ্য লোক মুনাজাতে অংশ নিতে ময়দানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বিপরীতমুখী মুসল্লিদের স্রোত দেখে ইজতেমা অভিমুখী মানুষ মনে করছিলেন হয়তো ভিড় এড়াতে তারা আগেই নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছেন, যা প্রতি বছরই ঘটে থাকে। মুনাজাত শেষ হয়ে গেছে এ সংবাদে বিশ্বাস না করেই মুসল্লিদের এ স্রোত ইজতেমা অভিমুখে যাচ্ছিল। আখেরি মুনাজাতে অংশ নেয়ার আশায় সকাল ১১টা পর্যন্ত ইজতেমা অভিমুখে মুসল্লিদের এ স্রোত ল্য করা গেছে। অবশেষে মুনাজাতে অংশ না নেয়ার আেেপ ইজতেমা অভিমুখী জনতার এ স্রোত বিপরীতমুখী (ইজতেমা থেকে বহির্গমন) জনস্রোতের সাথে একাকার হয়ে যায়। মুনাজাতে অংশ নিতে না পারায় এসব মুসল্লিকে ােভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রথম দফার ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে বহিরাগত মুসল্লিদের অংশ নেয়ার সুবিধার্থে ময়দানের আশপাশের এলাকায় মাইক সংযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফার আখেরি মুনাজাতে সেই ব্যবস্থা না থাকায় এমনিতেই লাখো মুসল্লি আখেরি মুনাজাতে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হন।
ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার তাবলিগ জামাতের স্বাগতিক বাংলাদেশের মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রোববার ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আখেরি মুনাজাত অনুষ্ঠানের সংবাদ ইতঃপূর্বে প্রচারিত হয়ে আসছিল। গত শনিবার বিকেলেও ইজতেমায় তাবলিগ মুরব্বিদের সাথে স্থানীয় সাংবাদিকদের মতবিনিময়কালে ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন আখেরি মুনাজাতের আলোচিত সময়ের (১১টা-১২টা) কথা নিশ্চিত করেন।
মহিলাদের অংশগ্রহণ : প্রচুরসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মহিলা ইজতেমার মুনাজাতে অংশ নেন। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় আখেরি মুনাজাতে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে, রাস্তায় বসে হাজার হাজার মহিলা মুনাজাতে অংশ নেন।
আরো ১ জনের মৃত্যু : তাবলিগ জামাতের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফার ইজতেমায় গত শনিবার রাতে আরো একজন মুসল্লি মারা গেছেন। মৃতের নাম আবদুল গণি (৬৫)। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার দাড়িয়ানি গ্রামে বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় দফার ইজতেমায় বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ট্রাক চাপায় এক মাদরাসা শিক্ষকসহ ৯ জনের মৃত্যু হলো।
ছাদে ১০০ সিটে ২৫০ : এ দিকে আখেরি মুনাজাত শেষে বিভিন্ন পরিবহনে মুসল্লিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। ইজতেমার পূর্বপাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্থানীয় মিলগেট বাস স্ট্যান্ডে ময়মনসিংহগামী বাসে ‘ছাদে ১০০, সিটে আড়াই শ’, ভেতরে দাঁড়িয়ে দেড় শ’ টাকা ভাড়ায় হেলপাররা মুসল্লিদের ডাকতে দেখা গেছে।
ট্রাফিক জ্যাম : আখেরি মুনাজাত নিয়ে সড়ক মহাসড়কগুলো ফুটপাথের ব্যবসায়ী ও মওসুমি ভিক্ষুকদের দখলে ছিল। ফলে মুনাজাত শেষে সড়কগুলোতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
তাবলিগ জামাত ও বিশ্ব ইজতেমা : ১৯১০ সালে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ:) তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন রাজস্থানের মেওয়াত এলাকা থেকে। তার নেতৃত্বে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এ কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস (রহ:) মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ) শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী, মাওলানা এনামুল হাসান, বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা আবদুল আজিজ এ কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৯৪৬ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে। ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৫-৬৭ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামে জাকারিয়া জুট মিলে অনুষ্ঠিত হয় খুব ছোট পরিসরে। এরই মধ্যে তাবলিগের কার্যক্রম গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালে তুরাগ নদীর বর্তমান স্থান নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার প্রতীকী মূল্যে বর্তমান ১৬১ একরের ময়দান তাবলিগ জামাতকে স্থায়ী বরাদ্দ দেয়।
২০১৫ সালের বিশ্ব ইজতেমা : গত বুধবার বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বিরা পরামর্শ করে আগামী ২০১৫ সালের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। সে অনুযায়ী আগামী বছরের ৯ জানুয়ারি শুরু হবে ইজতেমার তিন দিনব্যাপী প্রথম পর্ব। আবার চার দিন বিরতি দিয়ে তিন দিনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ১৬ জানুয়ারি। প্রথম দফার আখেরি মুনাজাত হবে ১১ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় দফার আখেরি মুনাজাত হবে ১৮ জানুয়ারি। বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী মো: গিয়াস উদ্দিন জানান, তাবলিগি প্রচার কাজের সুবিধার্থে ওই তারিখ এ বছরের চেয়ে এগিয়ে আনা হয়েছে।
দেশ-বিদেশের পথে ৫,৪০০ কাফেলার ইজতেমা ত্যাগ : দেশ-বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদের চিল্লাধারী (৪০ দিনে এক চিল্লা) পাঁচ হাজার ৪০০ জামাত ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করছে। তাদের মধ্যে ইজতেমার প্রথম দফার তিন হাজার ৪০০ ও দ্বিতীয় দফার দুই হাজার জামাত রয়েছে। প্রথম দফার তিন হাজার ৪০০ জামাতে রয়েছে ৭০০ বিদেশী মুসল্লির জামাত। তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলিগের (দ্বীন প্রচারের) কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন বলে তাবলিগ জামাতের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
নবী-রাসূলদের এ মহতী কাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবিই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দুই দফায় ছয় দিনের ইজতেমায় সুমহান এ তাবলিগি কাজেরই দীক্ষা গ্রহণ করেছেন লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলিম। শুধু ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেই নয়; তারা দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে চান সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে।
সূত্র - দৈনিক নয়াদিগন্ত, আলী ঝিলন ও শেখ আজিজুল হক
0 comments:
Post a Comment