Tuesday, May 6, 2014

নবুওয়াতের নমুনায় খিলাফতই - মুসলিমদের কল্যানের একমাত্র পথ -

নবুওয়াতের নমুনায় খিলাফতই : কল্যাণের একমাত্র পথ 

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি রাব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গ (রা), সাহাবায়ে কিরাম (রা) ও সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রাসূল।
পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য : আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতিকে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানব জাতি সৃষ্টির সূচনা লগ্নে ফিরিশতাদের সংগে আলোচনাকালে তিনি ঘোষণা করেন : (স্মরণ করুন!) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি...। (সুরা বাকারাহ : ৩০)
খিলাফত : পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত হল পার্থিব বিষয়ে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব এবং দুনিয়ার সমগ্র মাখলুকের উপর মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব। আল্লাহর খলিফা হিসাবে মানব জাতির দায়িত্ব হল আল্লাহর বিধান মোতাবেক সব কিছু পরিচালনা করা, নিজের মতে নয়, যা মূলত ইবাদতেরই অংশ। আদম (আ)-কে সৃষ্টির পর আল্লাহর হুকুমে ফিরিশতাদের সাথে সমগ্র মাখলুক হযরত আদম (আ)-কে সিজদা (বশ্যতা স্বীকার) করে মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব (খিলাফত)- এর স্বীকৃতি প্রদান করে। আল্লাহ বলেন : (স্মরণ করুন!) যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, এরপর ইবলিস ছাড়া তারা সকলেই সিজদা করল। ইবলিস অবাধ্য হল, অহঙ্কার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।- (বাকারাহ : ৩৪)
ইবাদাত : পৃথিবীতে মানব জাতির একমাত্র কাজ হল- সকল প্রকার তাগুতকে অমান্য করে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা এবং তার সাথে কোন কিছু শরীক না করা। আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর বিধান ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছুন্নাহ মোতাবেক অতিবাহিত করাকে ইবাদাত বলা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :
- আমি জ্বীন ও মানব জাতিকে কেবলমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি (সূরা যারিয়াত : ৫৬)। গোলামের নিজের কোন মত বা পছন্দ থাকে না, বরং তার প্রভুর মত ও পছন্দই গোলামের কাজ- এটাই ইবাদাতের মূল শিক্ষা। সুতরাং দুনিয়ার বুকে মানব জাতির একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হল- খিলাফাতের মর্যাদায় মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত।
খিলাফত ও ইবাদতের সূচনা : খিলাফত ও ইবাদতের মহান পরিকল্পনায় আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস্সাল্লাম এবং তার সঙ্গী হিসাবে হযরত হাওয়া আলাইহাস্সাল্লামকে সৃষ্টি করেন। উভয়কেই জান্নাতে বসবাসের নির্দেশ দেন। অতঃপর একদা হযরত আদম (আ)- এর সাথে তার বংশধর সমগ্র মানব জাতির রূহকে একত্রিত করে তাদের নিকট আল্লাহ তা›য়ালা তার প্রভুত্বের স্বীকৃতি আদায় করেন। আল্লাহ তা›য়ালা বলেন : স্মরণ করুন! যখন আপনার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করলেন এবং তাদের নিকট থেকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন এবং বললেন : আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল : হ্যাঁ, (অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক) এবং আমরা সাক্ষী রইলাম। এই স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্য এ কারণে যে, কিয়ামতের দিন যেন তোমরা বলতে না পার- ‘আমরা তো এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না।’ (সূরা আ’রাফ : ১৭২)
দুনিয়ায় প্রেরণের পূর্বে আল্লাহ তা›য়ালা হযরত আদম (আ)-কে সব কিছু শিক্ষা দেন। শয়তান তাদের বংশধরদেরকে কীভাবে বিপথগামী করতে পারে জান্নাতের মাঝে উভয়কে তার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেন। আল্লাহ তা›য়ালা বলেন : (১২০) এরপর শয়তান তাকে মন্দ পরামর্শ দিল। সে বলল : হে আদম! আমি কি আপনাকে চিরস্থায়ী জীবনদাতা গাছের এবং অনন্ত রাজ্যের সন্ধান দেব? (১২১) এরপর আদম ও হাওয়া সেই গাছের ফল খেয়ে ফেলল। তখন তাদের গোপন অঙ্গ তাদের পরস্পরের নিকট প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তারা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে ফেলতে লাগল। আদম তার পভুর হুকুম ভুলে গেল, ফলে সে ভুলের মধ্যে পড়ে গেল। -(সূরা ত্ব-হা : ১২০-১২১)
অতঃপর হযরত আদম (আ)-কে নবুওয়াত ও হিদায়াত প্রদান করে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা হিসাবে তাঁরই গোলামী করার জন্য পাঠালেন। তিনি বলেন : (১২২) এরপর তার প্রভু তাকে (আদম) নবী হিসেবে মনোনীত করলেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করলেন। (১২৩) তিনি বললেন : তোমরা (মানব এবং শয়তান) উভয়ে একসাথে পরস্পরের শত্রু হিসাবে জান্নাত থেকে নেমে যাও পরে আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে সঠিক পথের কোন নির্দেশনা আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং কোন দুঃখ-কষ্টও পাবে না। (১২৪) আর যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, তার জীবন-জীবিকা সংকুচিত করা হবে আর হাশরের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাবো। (১২৫) সে বলবে: হে আমার প্রভু! আমাকে কেন অন্ধ করে উঠালেন? আমি তো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ছিলাম! (১২৬) তিনি বলবেন : ‘আমার আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিল, যেভাবে তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে সেভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হয়েছে। (১২৭) যে বাড়াবাড়ি করে ও তার প্রভুর আয়াতসমূহে ঈমান আনে না, আমি এভাবেই তার প্রতিফল দেই। আর আখিরাতের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন এবং চিরস্থায়ী। -(সূরা ত্ব-হা : ১২২-১২৬)
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থতার পরিণাম : দুনিয়ার বুকে মানুষের মধ্যে যারা তাদের সৃষ্টি ও দুনিয়ায় প্রেরণের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তারা মনুষত্ব্যহীন। তাদের নিকৃষ্ট পাশবিকতার কারণে আল্লাহ তাদেরকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন, তাদের পরিণতি হল জাহান্নাম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা›য়ালা বলেন : আর আমি বহু জ্বীন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত অথবা পশুর চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট। বস্তুত তারাই উদাসীন। - (সূরা আরাফ : ১৭৯)
নবুওয়াতী মিশনের সূচনা ও বিরোধিতার পরিণাম :
নবুওয়াতী মিশনের সূচনা : হযরত আদম আলাইহিস্সাল্লাম দুনিয়ার বুকে আল্লাহ তা’য়ালার সর্বোত্তম সৃষ্টি, আল্লাহর বান্দা, আল্লাহর খলিফা এবং মানব জাতির আদি পিতা। আল্লাহ তা’য়ালা হযরত আদম (আ) এর বংশধর ভবিষ্যৎ মানবম-লীর জন্য তাকে সর্বপ্রথম নবী হিসাবে মনোনীত করেন। তিনি বলেন : এরপর তার প্রভু তাকে (আদম) নবী হিসেবে মনোনীত করলেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করলেন। (সূরা ত্ব-হা : ১২২)
নবুওয়াতী মিশনের কেন্দ্র হল মাসজিদ : দুনিয়ায় এসে হযরত আদম (আ) নবুওয়াতী মিশন পরিচালনা ও আল্লাহ তা›য়ালার ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম একখানা ঘরের প্রয়োজন বোধ করলেন। আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরের আকুতি পূরণের জন্য বায়তুল মামুর বরাবর দুনিয়ার বুকে একখানা ইবাদাত-গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা করে দিলেন। এ ঘরই হচ্ছে বর্তমান কা’বাগৃহ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় মানব জাতির জন্য প্রথম ঘর, বায়তুল্লাহ বা মাস্জিদ। খিলাফত সভ্যতার কেন্দ্র হল মাসজিদ : ধীরে ধীরে হযরত আদম (আ)-এর বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। এ ঘরকে কেন্দ্র করে মানব সমাজ গঠিত হয়। এভাবে আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে মানব জাতি তার ভবিষ্যৎ অভিযাত্রা শুরু করে। আর আল্লাহর সর্বপ্রথম নবী ও খলিফা হিসাবে হযরত আদম আলাইহিস্সাল্লাম এ মাস্জিদকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার বুকে এক হাজার বছর আল্লাহ তা›য়ালার হুকুমে নবুওয়াত ও কল্যাণময় খিলাফত প্রসাশন পরিচালনা করেন। অতঃপর তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে আল্লাহর মনোনীত নবী (আ)-গণ দুনিয়ার বুকে মানব সভ্যতায় আরও প্রায় এক হাজার বছর এ মহান দায়িত্ব পালন করেন।
নবুওয়তী মিশনের আহ্বান ও বিরোধিতার পরিণাম :
আল্লাহর মনোনীত সমস্ত নবী-রাসূল (আ)-গণ দুনিয়ার বুকে সকল তাগুতসমূহ পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদাতের দিকে মানব জাতিকে আহ্বান করেছেন। যারা তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি তারা দুনিয়ার থেকে নির্মূল হয়ে যায়। পবিত্র কুরআন থেকে এর কতিপয় উপমা তুলে ধরা হল। হযরত নূহ আলাইহিস্সাল্লামের বিবরণ : হযরত আদম আলাইহিস্সাল্লামের ইন্তিকালের প্রায় এক হাজার বছর পর তাঁর বংশধরদের মাঝে যখন শিরক দেখা দেয় তখন আল্লাহ তা›য়ালা হযরত নূহ আলাইহিস্সাল্লাম-কে তাদের মাঝে রিসালাত ও হিদায়াতসহ প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : আমি নূহকে তার জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন : হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর দিনের শাস্তির ভয় করছি। (আরাফ : ৫৯)
সূত ডা. গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম. দৈনিক ইনকিলাব

0 comments:

Post a Comment