শবে বরাত : ফযীলত ও আমল
ফার্সী ভাষায় ‘শব’ শব্দটির অর্থ রাত। ‘বরাত’ শব্দটি আরবী থেকে গৃহীত। বাংলায় ‘বরাত’ শব্দটি ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও আরবী ভাষায় এ শব্দটির অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরবী ভাষায় ‘বারাআত’ শব্দটির অর্থ বিমুক্ত, সম্পর্কছিন্নতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। ফার্সী ‘শবে বরাত’ ও আরবী ‘লাইলাতুল বারাআত’ অর্থাৎ ‘বিমুক্তির রজনী’ বলতে আরবী পঞ্জিকার ৮ম মাস, শাবান মাসের মধ্য রজনীকে বুঝানো হয়। কুরআন ও হাদীসে কোথাও ‘লাইলাতুল বারাআত’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার পাওয়া যায় না। এ রাতটিকে হাদীস শরীফে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘ মধ্য শাবানের রজনী’ বলা হয়েছে।
একজন মুমীনের জন্য ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ঐ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস-১৩৯৫}
তাই একজন মুমীন কখনই কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার বাইরে কোন কাজ করতে পারে না। আর করলেও তা কখনও ইবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শবে বরাতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।
কুরআন-হাদীসের নীতিমালা বহির্ভূত, রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত কোন বিষয়ের ব্যতিক্রম কোন বিশ্বাসের ভিত্তিতে শরীয়তের মাঝে নব উদ্ভাবিত যে কোন আমলই হল বিদআত। আমাদের সমাজে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে নানা রকম বিদআত গড়ে উঠেছে, যা কুরআন-হাদীস সমর্থিত নয়। এই প্রেক্ষাপটে একজন মুমীন হিসেবে শবে বরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা জেনে আমল করা উচিত।
মুফাসসীরগণের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আল-কুরআনের কোথাও শবে বরাত সম্পর্কে বলা হয়নি। কেউ কেউ সূরা দুখানের একটি আয়াত শবে বরাতের সমর্থনে পেশ করে থাকেন, আয়াতটি হল- ‘আমি তো তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুমোদিত হয়’। {সূরা ৪৪ দুখান, আয়াত-৩, ৪}
এই আয়াতে যে বরকতময় রজনীর কথা বলা হয়েছে, তা মূলত ‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’। শবে বরাত নয়। কেননা, কুরআন নাযিল হয়েছে যে রাত্রিতে, তা হল শবে কদরের রাত্রি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে কিছুই বলা হয়নি। তবে, হাদীস শরীফে শবে বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। নিম্নে ঐ বর্ণনা সমূহের একটি সার সংক্ষেপ পেশ করা হল।
হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস-১৩৮০}
অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মধ্য শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, অতঃপর বিদ্বেষী ও আত্মহননকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৬৩৫৩}
অনুরূপভাবে আবু সালাবাহ আল-খুশানী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুমীনদেরকে মার্জনা করে দেন। আর কাফেরদেরকে অবকাশ দেন এবং পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তাকে (আল্লাহকে) আহবান করে।’ {আল-মুজামুল কাবীর লিত তবরানী, হাদীস-১৮০৩৯}
অনুরূপভাবে আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহিমান্বিত মহান আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতঃপর ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-৬৭০}
সম্ভবত তৎকালীন সময়ে ‘কালব’ সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি মেষপালের মালিক ছিল। সে কারণেই ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং শিরকে লিপ্ত অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {বুগিইয়্যাতুল হারেছ, হাদীস-৩৩৫}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে বললেন, তুমি কি জানো আজকের রাত্রিটি কোন রাত্রি? তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসূল, এ রাত্রে কি আছে? তখন তিনি বললেন, ‘এ রাত্রে চলতি বছরে জন্ম গ্রহণকারী আদম সন্তানের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যু বরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং তাদেরকে রিযিক প্রদান করা হয়। অত:পর আয়েশা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে? তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহর রহমত ছাড়া কেহই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এ কথা তিনি তিন বার বললেন। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, আপনিও কি আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আয়েশার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আল্লাহর রহমত আমাকে ঢেকে না নিলে আমিও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো না। তিনি এ কথাটিও তিনবার বললেন।’ {মিশকাত শরীফ, হাদীস-১৩০৫}
অনেক হাদীস বিশারদগণ উক্ত হাদীসের সনদ বা বর্ণনা সুত্রকে দূর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ইমাম নাসায়ী এই হাদীসের সনদকে চলন সই বলে আখ্যায়িত বরেছেন। অনুরূপভাবে উসমান ইবনু আবিল আস্ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে তখন একজন আহবানকারী আহবান করতে থাকে, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন যাচনাকারী আছে কি? আমি তাকে দান করব। ব্যভিচারী ও শিরকে জড়িত ব্যতীত যত লোক যা কিছু চাইবে সকলকেই তা দেয়া হবে।’ {শুয়াবুল ঈমান লিল-বাইহাকী, হাদীস-৩৬৭৬}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, ‘এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাক্বীতে (মদীনা শরীফের একটি কবরস্থানের নাম) আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে আছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশংকা করেছিলে যে, আল্লাহ ও রাসূল সা. তোমার উপর অবিচার করবেন! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারনা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। তখন তিনি বললেন, মহিমান্বিত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং ‘কালব’ গোত্রের মেষপালের পশমের অধীক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করেন। {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদীস-১৩৭৯}
অনুরূপভাবে হযরত আলী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দুআয়) মশগুল থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ ঐ দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিযিক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক প্রদান করব। কোন দূর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’ {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদীস-১৩৭৮}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. একদা রাতে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি সিজদায় গিয়ে দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকলেন। এমনকি আমার মনে হলো যে, তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। আমি যখন এমনটি দেখলাম, তখন শোয়া থেকে উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। তখন আমি (বিছানায়) ফিরে গেলাম। অতঃপর যখন তিনি সিজদা থেকে মস্তক উঠালেন এবং নামায শেষ করলেন তখন বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি মনে করেছিলে যে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার সাথে প্রতারণা করছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারনে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.ই সম্যক অবগত। তিনি বললেন এটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে তার বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন, যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন এবং যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন।’ {শু’য়াবুল ঈমান লিল-বাইহাক্বী, হাদীস-৩৬৭৫}
উল্লেখিত হাদীস সমূহের কোন কোন বর্ণনাকারী যয়ীফ বা দূর্বল হিসেবে বিবেচিত হলেও একই অর্থবহ হাদীস (সামান্য কম বেশি ছাড়া) অন্য মুহাদ্দিসগণের নিকট চলনসই হিসেবে চিহ্নত। তাছাড়াও এই সমস্ত হাদীস দ্বারা যেহেতু কোন আহকাম অর্থাৎ নির্দেশ প্রমাণিত করা হচ্ছে না, বরং ফযীলত ও আমল সংক্রান্ত বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে, বিধায় মুহাদ্দিসগণের নিকট উল্লেখিত হাদীসসমূহ গ্রহণযোগ্য।
উল্লেখিত হাদীসসমূহে শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কিছু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে ফযীলতগুলো হল, এই রাতে ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেয়া হয়। চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী ও মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং রিযিক প্রদান করা হয় ইত্যাদি।
শবে বরাতের রাতে যে সকল লোকের আমল কবুল হয় না বলে বর্ণিত হয়েছে, এমন লোকের সংখ্যা প্রায় এগার। এক. মুশরিক অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে যে কোন প্রকারের শিরকে লিপ্ত হয়। আল্লাহর নাম ও গুণগত বিষয়ের শিরক হোক বা আল্লাহর প্রতিপালনগত বিষয়ের শিরক হোক অথবা আল্লাহর ইবাদতগত বিষয়ের শিরক হোক। দুই. যে ব্যক্তি কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী। তিন. আত্মহত্যার ইচ্ছা পোষণকারী। চার. যে ব্যক্তি অপরের ভাল দেখতে পারে না অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতায় লিপ্ত। পাঁচ. যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, চাই তা নিকটতম আত্মীয় হোক বা দূরবর্তী আত্মীয় হোক। ছয়. যে ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাছাড়াও অন্য হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সাত. যে ব্যক্তি মদ্যপানকারী অর্থাৎ নেশাকারী। আট. যে ব্যক্তি গণকগিরি করে বা গণকের কাছে গমণ করে। নয়. যে ব্যক্তি জুয়া খেলে। দশ. যে ব্যক্তি মাতা-পিতার অবাধ্য হয়। এগার. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ ইত্যাদি ব্যক্তির দুআও তওবা না করা পর্যন্ত কবুল হয় না। তাই শবে বরাতের পূর্ণ ফযীলত ও শবে বরাতের রাতে দুআ কবুল হওয়ার জন্য উল্লেখিত কবীরা গুনাহ সমূহ থেকে খাঁটি দিলে তওবা করা উচিত। অন্যথায় সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করেও কোন লাভের আশা করা যায় না।
শবে বরাতের আমল বা করনীয় সম্পর্কে উল্লেখিত হাদীসসমূহ থেকে যা জানা যায় তা হল, এক. এই রাতে কবর যিয়ারত করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই দলবদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ না হয়ে একাকী হওয়া উচিত। দুই. শবে বরাতের রাত্রিতে নামায-দুআ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দরূদ শরীফ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা ভাল। তিন. এই রাত্রিতে দীর্ঘ সিজদায় রত হওয়া উচিত। চার. শবে বরাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই শাবান রোযা রাখা।
তাছাড়া প্রত্যেক আরবী মাসের তের, চৌদ্দ ও পনেরতম তারিখে রোযা রাখা অধিক মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ‘রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, প্রত্যেক মাসে তিনটি রোযা এক বৎসরের রোযার ন্যায়। আর আইয়্যামুল বীয (পূর্ণ চন্দ্রময় রজনীর দিবসসমূহ) হল, তের, চৌদ্দ ও পনেরতম দিবস।’ {নাসাঈ শরীফ, হাদীস-২৩৭৭}
তবে, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বেশ কিছু কুসংস্কার ও বিদআত চালু আছে। তম্মধ্যে অন্যতম বিদআত হল হালুয়া-রুটি তৈরী করার এক মহা ধুমধাম। যা নিঃসন্দেহে একটি কুসংস্কার ও বিদআত। তাই, এটি বর্জন করা উচিৎ। সেই সাথে বিভিন্ন কবরস্থানে বা মসজিদে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়ের গুনাহসহ মস্তবড় একটি বিদআত। সারারাত্রি জাগরণ করে ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে শুধু মসজিদে-মসজিদে ঘোরাঘুরি করা আর রাস্তায়-রাস্তায় গল্প-গুজবে মশগুল থাকা এই রাত্রির মর্যাদা পরিপন্থি কাজ। বরং, এই রাত্রিতে মসজিদে সমবেত না হয়ে বাড়িতে একাকী ইবাদত করাই উত্তম। মসজিদে তো দৈনিক পাঁচবার নামাযের ইবাদত হচ্ছেই। নিজেদের বাসা-বাড়িকেও ইবাদতের গৃহ হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তাছাড়াও সকল নফল ইবাদত মসজিদের চাইতে বাড়িতে পালন করাই উত্তম। সারারাত নফল ইবাদত পালন করে যদি ফজরের নামায কাযা হয়ে যায়, এর চাইতে দূর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? যদি কারো জীবনে কাযা নামায থেকে থাকে, তাহলে নফল নামায পড়ার চাইতে বিগত জীবনের কাযা নামায আদায় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং জরুরী। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তার কুরআন ও হাদীস সম্মত পন্থায় ইবাদত পালনের তাওফীক দিন। আমীন।
একজন মুমীনের জন্য ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ঐ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস-১৩৯৫}
তাই একজন মুমীন কখনই কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার বাইরে কোন কাজ করতে পারে না। আর করলেও তা কখনও ইবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শবে বরাতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।
কুরআন-হাদীসের নীতিমালা বহির্ভূত, রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত কোন বিষয়ের ব্যতিক্রম কোন বিশ্বাসের ভিত্তিতে শরীয়তের মাঝে নব উদ্ভাবিত যে কোন আমলই হল বিদআত। আমাদের সমাজে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে নানা রকম বিদআত গড়ে উঠেছে, যা কুরআন-হাদীস সমর্থিত নয়। এই প্রেক্ষাপটে একজন মুমীন হিসেবে শবে বরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা জেনে আমল করা উচিত।
মুফাসসীরগণের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আল-কুরআনের কোথাও শবে বরাত সম্পর্কে বলা হয়নি। কেউ কেউ সূরা দুখানের একটি আয়াত শবে বরাতের সমর্থনে পেশ করে থাকেন, আয়াতটি হল- ‘আমি তো তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুমোদিত হয়’। {সূরা ৪৪ দুখান, আয়াত-৩, ৪}
এই আয়াতে যে বরকতময় রজনীর কথা বলা হয়েছে, তা মূলত ‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’। শবে বরাত নয়। কেননা, কুরআন নাযিল হয়েছে যে রাত্রিতে, তা হল শবে কদরের রাত্রি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে কিছুই বলা হয়নি। তবে, হাদীস শরীফে শবে বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। নিম্নে ঐ বর্ণনা সমূহের একটি সার সংক্ষেপ পেশ করা হল।
হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস-১৩৮০}
অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মধ্য শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, অতঃপর বিদ্বেষী ও আত্মহননকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৬৩৫৩}
অনুরূপভাবে আবু সালাবাহ আল-খুশানী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুমীনদেরকে মার্জনা করে দেন। আর কাফেরদেরকে অবকাশ দেন এবং পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তাকে (আল্লাহকে) আহবান করে।’ {আল-মুজামুল কাবীর লিত তবরানী, হাদীস-১৮০৩৯}
অনুরূপভাবে আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহিমান্বিত মহান আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতঃপর ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-৬৭০}
সম্ভবত তৎকালীন সময়ে ‘কালব’ সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি মেষপালের মালিক ছিল। সে কারণেই ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং শিরকে লিপ্ত অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। {বুগিইয়্যাতুল হারেছ, হাদীস-৩৩৫}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে বললেন, তুমি কি জানো আজকের রাত্রিটি কোন রাত্রি? তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসূল, এ রাত্রে কি আছে? তখন তিনি বললেন, ‘এ রাত্রে চলতি বছরে জন্ম গ্রহণকারী আদম সন্তানের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যু বরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং তাদেরকে রিযিক প্রদান করা হয়। অত:পর আয়েশা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে? তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহর রহমত ছাড়া কেহই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এ কথা তিনি তিন বার বললেন। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, আপনিও কি আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আয়েশার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আল্লাহর রহমত আমাকে ঢেকে না নিলে আমিও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো না। তিনি এ কথাটিও তিনবার বললেন।’ {মিশকাত শরীফ, হাদীস-১৩০৫}
অনেক হাদীস বিশারদগণ উক্ত হাদীসের সনদ বা বর্ণনা সুত্রকে দূর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ইমাম নাসায়ী এই হাদীসের সনদকে চলন সই বলে আখ্যায়িত বরেছেন। অনুরূপভাবে উসমান ইবনু আবিল আস্ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে তখন একজন আহবানকারী আহবান করতে থাকে, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন যাচনাকারী আছে কি? আমি তাকে দান করব। ব্যভিচারী ও শিরকে জড়িত ব্যতীত যত লোক যা কিছু চাইবে সকলকেই তা দেয়া হবে।’ {শুয়াবুল ঈমান লিল-বাইহাকী, হাদীস-৩৬৭৬}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, ‘এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাক্বীতে (মদীনা শরীফের একটি কবরস্থানের নাম) আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে আছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশংকা করেছিলে যে, আল্লাহ ও রাসূল সা. তোমার উপর অবিচার করবেন! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারনা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। তখন তিনি বললেন, মহিমান্বিত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং ‘কালব’ গোত্রের মেষপালের পশমের অধীক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করেন। {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদীস-১৩৭৯}
অনুরূপভাবে হযরত আলী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দুআয়) মশগুল থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ ঐ দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিযিক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক প্রদান করব। কোন দূর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’ {সুনানে ইবনু মাযাহ, হাদীস-১৩৭৮}
অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. একদা রাতে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি সিজদায় গিয়ে দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকলেন। এমনকি আমার মনে হলো যে, তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। আমি যখন এমনটি দেখলাম, তখন শোয়া থেকে উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। তখন আমি (বিছানায়) ফিরে গেলাম। অতঃপর যখন তিনি সিজদা থেকে মস্তক উঠালেন এবং নামায শেষ করলেন তখন বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি মনে করেছিলে যে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার সাথে প্রতারণা করছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারনে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.ই সম্যক অবগত। তিনি বললেন এটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে তার বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন, যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন এবং যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন।’ {শু’য়াবুল ঈমান লিল-বাইহাক্বী, হাদীস-৩৬৭৫}
উল্লেখিত হাদীস সমূহের কোন কোন বর্ণনাকারী যয়ীফ বা দূর্বল হিসেবে বিবেচিত হলেও একই অর্থবহ হাদীস (সামান্য কম বেশি ছাড়া) অন্য মুহাদ্দিসগণের নিকট চলনসই হিসেবে চিহ্নত। তাছাড়াও এই সমস্ত হাদীস দ্বারা যেহেতু কোন আহকাম অর্থাৎ নির্দেশ প্রমাণিত করা হচ্ছে না, বরং ফযীলত ও আমল সংক্রান্ত বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে, বিধায় মুহাদ্দিসগণের নিকট উল্লেখিত হাদীসসমূহ গ্রহণযোগ্য।
উল্লেখিত হাদীসসমূহে শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কিছু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে ফযীলতগুলো হল, এই রাতে ‘কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেয়া হয়। চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী ও মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানের আমল কবুল করা হয় এবং রিযিক প্রদান করা হয় ইত্যাদি।
শবে বরাতের রাতে যে সকল লোকের আমল কবুল হয় না বলে বর্ণিত হয়েছে, এমন লোকের সংখ্যা প্রায় এগার। এক. মুশরিক অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে যে কোন প্রকারের শিরকে লিপ্ত হয়। আল্লাহর নাম ও গুণগত বিষয়ের শিরক হোক বা আল্লাহর প্রতিপালনগত বিষয়ের শিরক হোক অথবা আল্লাহর ইবাদতগত বিষয়ের শিরক হোক। দুই. যে ব্যক্তি কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী। তিন. আত্মহত্যার ইচ্ছা পোষণকারী। চার. যে ব্যক্তি অপরের ভাল দেখতে পারে না অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতায় লিপ্ত। পাঁচ. যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, চাই তা নিকটতম আত্মীয় হোক বা দূরবর্তী আত্মীয় হোক। ছয়. যে ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাছাড়াও অন্য হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সাত. যে ব্যক্তি মদ্যপানকারী অর্থাৎ নেশাকারী। আট. যে ব্যক্তি গণকগিরি করে বা গণকের কাছে গমণ করে। নয়. যে ব্যক্তি জুয়া খেলে। দশ. যে ব্যক্তি মাতা-পিতার অবাধ্য হয়। এগার. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ ইত্যাদি ব্যক্তির দুআও তওবা না করা পর্যন্ত কবুল হয় না। তাই শবে বরাতের পূর্ণ ফযীলত ও শবে বরাতের রাতে দুআ কবুল হওয়ার জন্য উল্লেখিত কবীরা গুনাহ সমূহ থেকে খাঁটি দিলে তওবা করা উচিত। অন্যথায় সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করেও কোন লাভের আশা করা যায় না।
শবে বরাতের আমল বা করনীয় সম্পর্কে উল্লেখিত হাদীসসমূহ থেকে যা জানা যায় তা হল, এক. এই রাতে কবর যিয়ারত করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই দলবদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ না হয়ে একাকী হওয়া উচিত। দুই. শবে বরাতের রাত্রিতে নামায-দুআ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দরূদ শরীফ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা ভাল। তিন. এই রাত্রিতে দীর্ঘ সিজদায় রত হওয়া উচিত। চার. শবে বরাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই শাবান রোযা রাখা।
তাছাড়া প্রত্যেক আরবী মাসের তের, চৌদ্দ ও পনেরতম তারিখে রোযা রাখা অধিক মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ‘রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, প্রত্যেক মাসে তিনটি রোযা এক বৎসরের রোযার ন্যায়। আর আইয়্যামুল বীয (পূর্ণ চন্দ্রময় রজনীর দিবসসমূহ) হল, তের, চৌদ্দ ও পনেরতম দিবস।’ {নাসাঈ শরীফ, হাদীস-২৩৭৭}
তবে, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বেশ কিছু কুসংস্কার ও বিদআত চালু আছে। তম্মধ্যে অন্যতম বিদআত হল হালুয়া-রুটি তৈরী করার এক মহা ধুমধাম। যা নিঃসন্দেহে একটি কুসংস্কার ও বিদআত। তাই, এটি বর্জন করা উচিৎ। সেই সাথে বিভিন্ন কবরস্থানে বা মসজিদে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়ের গুনাহসহ মস্তবড় একটি বিদআত। সারারাত্রি জাগরণ করে ইবাদত-বন্দেগীর চাইতে শুধু মসজিদে-মসজিদে ঘোরাঘুরি করা আর রাস্তায়-রাস্তায় গল্প-গুজবে মশগুল থাকা এই রাত্রির মর্যাদা পরিপন্থি কাজ। বরং, এই রাত্রিতে মসজিদে সমবেত না হয়ে বাড়িতে একাকী ইবাদত করাই উত্তম। মসজিদে তো দৈনিক পাঁচবার নামাযের ইবাদত হচ্ছেই। নিজেদের বাসা-বাড়িকেও ইবাদতের গৃহ হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তাছাড়াও সকল নফল ইবাদত মসজিদের চাইতে বাড়িতে পালন করাই উত্তম। সারারাত নফল ইবাদত পালন করে যদি ফজরের নামায কাযা হয়ে যায়, এর চাইতে দূর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? যদি কারো জীবনে কাযা নামায থেকে থাকে, তাহলে নফল নামায পড়ার চাইতে বিগত জীবনের কাযা নামায আদায় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং জরুরী। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তার কুরআন ও হাদীস সম্মত পন্থায় ইবাদত পালনের তাওফীক দিন। আমীন।
0 comments:
Post a Comment