Thursday, January 7, 2016

দাওয়াতে তাবলিগ ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য - কি এবং কেন তাবলিগ

কেন তাবলিগ করব -দাওয়াতে তাবলিগ ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য

আতাউর রহমান কাবুল   

দাওয়াতের অর্থ হলো আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। আর তাবলিগ হচ্ছে আল্লাহর এবাদতের দিকে মানুষকে আহ্বান করা। 'তাবলিগ' শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রচার, প্রসার, ইসলামের দাওয়াত, বয়ান ও প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো ইত্যাদি। 



একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো বা অন্যকে শিক্ষা দেওয়াকে তাবলিগ বলা হয়। তাবলিগের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সঙ্গে মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তাঁর কাছ থেকে সব সমস্যার সমাধান লাভ করে ইহকাল ও পরকালে শান্তি সফলতা পায়।

আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর সাথে জোড়া লাগানোই মূল কাজ। 

ইসলামে দাওয়াতে তাবলিগের গুরুত্ব

নবী-রাসুলদের মূল দায়িত্ব ছিল দাওয়াত ও তাবলিগ। নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) যে কাজ করতেন সে কাজের দায়িত্ব তাঁদের অবর্তমানে মুসলিম উম্মাহর ওপর বর্তায়। মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে দুনিয়ায় তাবলিগ শুরু হয়। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসুল প্রেরণ করা হয়েছে। যেহেতু আর কোনো নবী-রাসুল দুনিয়ায় আসবেন না, তাই তাবলিগের আমলের দায়িত্ব ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের।



দশম হিজরিতে আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, 'আমিই সর্বশেষ নবী বিধায় নবুওয়াত ও রিসালাতের অব্যাহত ধারার এখানেই পরিসমাপ্তি। অনাগত কালের মানুষের জন্য দ্বীনের পরিচয় বিধৃত আল কোরআন ও সুন্নাহ রেখে গেলাম। এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের।' (ভাবানুবাদ) সাহাবিরা এ বক্তব্য শোনার পরপরই তাবলিগ করার জন্য তথা দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সারা পৃথিবীতে সফর করেন। এভাবে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, ওলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশ ও হাক্কানি আলেম সমাজের কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিসর্জনের জন্য তাবলিগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে।


প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, 'আমার একটি বাক্যও যদি তোমাদের কারো কাছে পৌঁছে থাকে, তবে তা অন্যদের পৌঁছে দাও।' রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশ পালন করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি। দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য মুসলমানদের এক জামাত বিশ্বব্যাপী এ কাজটিই করছে।
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, 'তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি; মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের নির্বাচন করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।' (সুরা আলে ইমরান : ১১০)
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, 'তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক, যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আহ্বান করবে, আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। ওই দলটাই হলো সাফল্য লাভকারী।' (সুরা আলে ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মুমিনগণ! তোমাদের কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদের কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? (তা হলো) তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসুলের ওপর ইমান আনবে এবং জিহাদ করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।' (সুরা আস-সাফ : ১০)।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং সে বলে, আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।' (সুরা হা-মীম আস-সিজদা : ৩৩)।
নিজেকে তৈরি করা ও অন্যকে দাওয়াত দেওয়া
দাওয়াতের মেহনত কোনো নতুন কিছু নয়। এই মেহনত আল্লাহর প্রিয় বান্দা নবী-রাসুল থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম করে গেছেন। অন্য ভাইয়ের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে হেকমত ও ধৈর্যের সঙ্গে। অন্য ভাইয়ের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর আগে তার অবস্থা জানতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দ্বীনের পথে আনতে হবে।
তাই দাওয়াতে তাবলিগের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করা ও অন্যকে দাওয়াত দেওয়া। এই আমলের দ্বারাই অন্তরে বিশ্বাস স্থাপিত হয়ে আমলও বিশুদ্ধ হয়ে যায়।

প্রচলিত তাবলিগের কার্যক্রম

কোনো দেশ, কোনো অঞ্চল বা কোনো গোষ্ঠীবিশেষের জন্য ইসলাম ধর্ম প্রেরিত হয়নি। ইসলাম সমগ্র বিশ্বের সব যুগের সব মানুষের ধর্ম। তাই দুনিয়াবাসীর জন্য ইসলামই হলো একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত এক লাখ মতান্তরে দুই লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসুল দাওয়াত ও তাবলিগের দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করে গেছেন। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ও ওফাতের মাধ্যমে এ ধারার সমাপ্তি ঘটে। হুজুরে পাক (সা.)-এর পর থেকে এ দায়িত্ব খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, সালফে সালেহিন এবং আলেমরা পালন করছেন। ১৯৪১ সালে দিল্লির মেওয়াতে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করেন। এর সমপ্রসারিত রূপ আজকের টঙ্গীর তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা। মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি হাসিলের উদ্দেশ্যে এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনা এবং আমলে সালেহ করাই এ দাওয়াতের মুখ্য বিষয়।

দ্বীনি দাওয়াতের অর্থ হলো দ্বীনের পথে মানুষকে আহ্বান করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সমাজ থেকে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে নীতি-নৈতিকতার ভিত এমনভাবে ধসে পড়ছে যে, মনে হয় এ থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো পথই খোলা নেই। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হলো সবাইকে এই দ্বীনি দাওয়াতের কাজে এগিয়ে আসা। আল্লাহ তায়ালা এ দাওয়াতি কাজটি ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে সবার ওপর সমানভাবে দিয়ে দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক মানুষের ওপরই তার স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী সত্যের প্রচার করা ফরজ।
পথভোলা মানুষকে পথের সন্ধান দেওয়া, বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে আনা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, চরিত্রবান ও সৎ সাহসী করা, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, এতিম, অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, মহৎ কর্মের উপমা সৃষ্টি করা, ভালো কাজে উৎসাহী করা, মন্দ থেকে বিরত রাখা, কর্মচঞ্চল করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া, এককথায় ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত বা তাবলিগ।
দাওয়াত ও তাবলিগে সময়, জান ও মাল উৎসর্গ করে আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। তবেই মানুষ আহ্বানে সাড়া দেবে। নিজের আত্মিক উন্নতি ও দ্বীন শিক্ষার জন্য বাইরে না গেলে কোনো ব্যক্তির রুহানি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই দ্বীন শিখতে হলে ঘর ছাড়তে হবে। সব নবী রাসুলই এ কাজ করে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) নবুওয়াতের আগে দীর্ঘদিন যাবত হেরা গুহায় মেহনত করেছিলেন কিভাবে জাতিকে তাওহিদমুখী করা যায়। তারপর আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াতের মতো মর্যাদাকর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। সুতরাং মেহনত ছাড়া এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
তাই আসুন, আমরা আমিত্ব ও স্বার্থের বন্ধন ছিন্ন করে ইমানদার ও ভালো মানুষ হই। নিজে আমলে সালেহ বা নেক কাজ করি এবং কথা, কাজ, বক্তৃতা ও লিখনীর মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের সুস্পষ্ট চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরি। বাস্তব জীবনে এর উজ্জ্বল নমুনা পেশ করি। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে মানুষকে প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে 'আল্লাহর রজ্জু'কে মজবুত করে ধরতে শিখি। কেননা, আধুনিক যুগে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য, বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের কোনো বিকল্প নেই। সেই দ্বীনি মেহনতের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।


0 comments:

Post a Comment