Thursday, March 8, 2018

এক নজরে নামাজের বিধিবিধান

এক নজরে নামাজের বিধিবিধান

সালাত বা নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। ঈমানের পরই নামাজের স্থান। নামাজ মুসলমানিত্বের পরিচায়ক। আল্লাহর আনুগত্যের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে নামাজের মাধ্যমে। 



নামাজের ফরজ 

নামাজের ফরজ ১৩টি। (নামাজের বাইরে ফরজ সাতটি)
১. শরীর পবিত্র হওয়া। (সুরা মায়িদা, আয়াত ৬; তিরমিজি, হাদিস : ১, ৩ হাসান)

২. কাপড় পবিত্র হওয়া। (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত ৪; তিরমিজি, হাদিস : ১, ৩ হাসান)
৩. নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়া। (সুরা বাকারা, আয়াত ১২৫; তিরমিজি, হাদিস : ১, ৩ হাসান)
৪. সতর ঢাকা (অর্থাৎ পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ও নারীদের চেহারা, দুই হাত কবজি পর্যন্ত ও পায়ের পাতা ছাড়া গোটা শরীর ঢেকে রাখা। মনে রাখা আবশ্যক, পর্দার ক্ষেত্রে নারীদের পুরো শরীরই সতরের অন্তর্ভুক্ত)। (সুরা আরাফ, আয়াত ৩১; সুরা নুর, আয়াত ৩১; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৬ হাসান, মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৬৭৫৬ হাসান, তিরমিজি ১/২২২, হাদিস : ১১৭৩, ৩৭৭ সহিহ, আবু দাউদ ১/৯৪, হাদিস : ৬৪১ সহিহ, ২/৫৬৭, হাদিস : ৪১০৪ গ্রহণযোগ্য, মারাসিলে আবি দাউদ, ৮৬ হাদিস : ২৮ গ্রহণযোগ্য)
৫. কিবলামুখী হওয়া। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৪৪; বুখারি ২/৯২৪, হাদিস : ৬২৫১)
৬. ওয়াক্তমতো নামাজ পড়া। (সুরা নিসা, আয়াত ১০৩; বুখারি ১/৭৫, হাদিস : ৫২১)
৭. অন্তরে নির্দিষ্ট নামাজের নিয়ত করা। (বুখারি শরিফ ১/২, হাদিস : ১)

নামাজের ভেতরে ছয়টি ফরজ

১. তাকবিরে তাহরিমা, অর্থাৎ শুরুতে আল্লাহু আকবার বলা।
    (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত ৩; বুখারি ১/১০১, হাদিস : ৮৩৩, মুসলিম ১/১৭৬, হাদিস : ৪১১, ৪১২, তিরমিজি ১/৫৫, হাদিস : ২৩৮)
২. ফরজ ও ওয়াজিব নামাজ দাঁড়িয়ে পড়া। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৩৮; বুখারি ১/১৫০, হাদিস : ১১১৭, তিরমিজি ১/৬৬, হাদিস : ৩০৪ সহিহ)
৩. কেরাত পড়া (অর্থাৎ কোরআন শরিফ থেকে ন্যূনতম ছোট এক আয়াত পরিমাণ পড়া ফরজ।) (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত ২০; বুখারি ২/৯২৪, হাদিস : ৬২৫১, তিরমিজি ১/৬৬, ৬৭, হাদিস : ৩০২, ৩০৩ সহিহ)
৪. রুকু করা। (সুরা হজ, আয়াত ৭৭; বুখারি ১/১৫০, হাদিস : ১১১৩, ১১১৪, মুসলিম ১/১৭৭, হাদিস : ৪১২)
৫. দুই সিজদা করা। (সুরা হজ, আয়াত ৭৭; বুখারি ১/১০১, হাদিস : ৭৩৩, মুসলিম ১/১৭৬, হাদিস : ৪১১)
৬. শেষ বৈঠক (নামাজের শেষে তাশাহুদ পরিমাণ বসা) (আবু দাউদ : ১/১৩৯, হাদিস : ৯৭০ সহিহ)
বি. দ্র. : নামাজি ব্যক্তির নিজস্ব কোনো কাজের মাধ্যমে (যেমন—সালাম ফেরানো ইত্যাদি) নামাজ থেকে বের হওয়াও একটা ফরজ। (আল বাহরুর রায়িক, ১ : ৫১৩)
নামাজের কোনো ফরজ বাদ পড়লে নামাজ বাতিল হয়ে যায়। সাহু সিজদা করলেও নামাজ শুদ্ধ হয় না। (আল বাহরুর রায়িক, ১:৫০৫) ফাতাওয়া শামি, ১:৪৪৭/হিদায়া, ১ : ৯৮)
 নামাজের ওয়াজিব
১. প্রথম দুই রাকাতে সুরা ফাতিহা পূর্ণ পড়া। (বুখারি, হাদিস : ৭৫৬)
২. প্রথম দুই রাকাতে সুরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য একটি সুরা বা ছোট তিন আয়াত পরিমাণ মেলানো। (বুখারি শরিফ ১/১০৫, হাদিস : ৭৭৬, মুসলিম ১/১৮৫, হাদিস : ৪৫১)
৩. ফরজের প্রথম দুই রাকাতকে কেরাতের জন্য নির্দিষ্ট করা। (বুখারি শরিফ ১/১০৫, হাদিস : ৭৭৬, মুসলিম ১/১৮৫, হাদিস : ৪৫১)
৪. সুরা ফাতিহা অন্য সুরার আগে পড়া। (বুখারি ১/১০২, ১০৩, হাদিস : ৭৪৩, মুসলিম ১/১৯৪, হাদিস : ৪৯৮ তিরমিজি, হাদিস : ১/৫৭, হাদিস : ২৪৬ সহিহ)
৫. নামাজের সব রুকন ধীরস্থিরভাবে আদায় করা। (অর্থাৎ রুকু, সিজদা ও রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও দুই সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে বসে কমপক্ষে এক তাসবিহ পরিমাণ দেরি করা)। (বুখারি ১/১০৯, হাদিস : ৭৯৩, মুসলিম ১/১৭০, হাদিস : ৩৯৭, আবু দাউদ ১/১২৪, ১২৪, হাদিস : ৮৫৬, ৮৫৭, ৮৫৮)
৬. প্রথম বৈঠক করা (অর্থাৎ তিন অথবা চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের দুই রাকাতের পর বসা)। (বুখারি ১/১১৪, হাদিস : ৮২৮)
৭. উভয় বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়া। (বুখারি শরিফ ১/১১৫, হাদিস : ৮৩০, ৮৩১, মুসলিম ১/১৯৪, ১৭৩, হাদিস : ৪৯৮, ৪০২, ৪০৩, তিরমিজি ১/৮৯, হাদিস : ৩৯১ সহিহ)
৮. প্রতি রাকাতের ফরজ ও ওয়াজিবগুলোর তারতিব বা ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা। (বুখারি ২/৯২৪, হাদিস : ৬২৫১, তিরমিজি ১/৬৬, ৬৭, হাদিস : ৩০২, ৩০৩ সহিহ)
৯.  ফরজ ও ওয়াজিবগুলোকে নিজ নিজ স্থানে আদায় করা। (যেমন—দ্বিতীয় সিজদা প্রথম সিজদার সঙ্গে করা। প্রথম বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু শেষ করে তৎক্ষণাৎ তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি। (বুখারি ২/৯২৪, হাদিস : ৬২৫১, তিরমিজি ১/৬৬, ৬৭, হাদিস : ৩০২, ৩০৩ সহিহ)
১০. বিতর নামাজে তৃতীয় রাকাতে কিরাতের পর কোনো দোয়া পড়া। অবশ্য দোয়া কুনুত পড়লে ওয়াজিবের সঙ্গে সুন্নাতও আদায় হয়ে যাবে। (বুখারি ১/১৩৬, হাদিস : ১০০২, তিরমিজি ১/১০৬, হাদিস : ৪৬৪১ হাসান, ইবনে মাজাহ ১/৮৩, হাদিস : ১১৮২ সহিহ)
১১. দুই ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয় তাকবির বলা। (আবু দাউদ ১/১৬৩, হাদিস : ১১৫৩ হাসান, মুসনাদে আহমদ ৪/৪১৬, হাদিস : ১৯৭৩৪ হাসান, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ২/১৭২, হাদিস : ৫৬৯৪ হাসান, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ৩/২৯৩, হাদিস : ৫৬৮৬ সহিহ)
১২. দুই ঈদের নামাজে দ্বিতীয় রাকাতে অতিরিক্ত তিন তাকবির বলার পর রুকুতে যাওয়ার সময় ভিন্নভাবে তাকবির বলা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ ১/৪৯৫, হাদিস : ৫৭০৭ সহিহ, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ৩/২৯৩ হাদিস : ৫৬৮৬ সহিহ, তাহাবি ৪/৩৪৮, হাদিস : ১৬৭৪ সহিহ) (এ তাকবিরটি অন্যান্য নামাজে সুন্নাত)
১৩. ইমামের জন্য জোহর, আসর এবং দিনের বেলায় সুন্নাত ও নফল নামাজে কেরাত আস্তে পড়া। আর ফজর, মাগরিব, এশা, জুমা, দুই ঈদ, তারাবিহ ও রমজান মাসের বিতির নামাজে কেরাত শব্দ করে পড়া। (মুসলিম ১/২৯১, হাদিস : ২৫৯, নাসায়ি ১/১১২, হাদিস : ৯৭০ সহিহ, তিরমিজি ১/১০৬, হাদিস : ৪৬৩ , ইবনে মাজাহ ৯৬, হাদিস : ১৩৪৯, সহিহ মারাসিলে আবু দাউদ ৯৩, হাদিস : ৪১ সহিহ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ ৪/১৩৬, হাদিস : ৫৪৫২ সহিহ) (আস্তে পড়ার অর্থ মনে মনে পড়া নয়। কেননা এতে নামাজ শুদ্ধ হয় না। বরং আওয়াজ না করে মুখে উচ্চারণ করে পড়া জরুরি।)
১৪. সালামের মাধ্যমে নামাজ শেষ করা। (বুখারি ১/১১৫, হাদিস : ৮৩৭, আবু দাউদ ১/১৪৩, হাদিস : ৯৯৬ সহিহ)
    বি. দ্র. : উল্লিখিত ওয়াজিবগুলো থেকে কোনো একটি ভুলে ছুটে গেলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়া শামি, ১৪:৪৫৬, আলমগিরি, ১:৭১, আল বাহরুর রায়িক, ১:৫১০)

 নামাজে কেরাতের সুন্নাত সাতটি

১. প্রথম রাকাতে ছানা পড়ার পর পূর্ণ আউজুবিল্লাহ পড়া। (আবু দাউদ ১/১১১, হাদিস : ৭৬৪, ইবনে মাজাহ ১/৪৪৩, হাদিস : ৮০৭)
২. প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহা ও সুরা মেলানোর আগে পূর্ণ বিসমিল্লাহ পড়া। (নাসায়ি ১/১০৪, হাদিস : ৯০৪)
৩. সুরা ফাতিহার পর ইমাম, মুক্তাদি বা একাকী নামাজি সবাই নীরবে ‘আমিন’ বলা। (বুখারি ১/১০৮, হাদিস : ৭৮২, মুস্তাদরাকে হাকেম ২/২৩২, হাদিস : ২৯১৩, সুনানে দারা কুতনি ১/২৬৩, হাদিস : ১২৫৬)
৪. ফজর ও জোহরের নামাজে ত্বিওয়ালে মুফাসসাল (লম্বা কেরাত), অর্থাৎ সুরা ‘হুজুরাত’ থেকে সুরা ‘বুরূজ’ পর্যন্ত যেকোনো সুরা পড়া। আসর ও এশার নামাজে আউসাতে মুফাসসাল (মধ্যম কেরাত) অর্থাৎ সুরা ‘ত্বারিক’ থেকে সুরা ‘লাম-ইয়াকুন’ পর্যন্ত যেকোনো সুরা পড়া। মাগরিবে কিসারে মুফাসসাল (ছোট কেরাত) অর্থাৎ সুরা ‘ইজা-জুলজিলাৎ’ থেকে সুরা ‘নাস’ পর্যন্ত প্রতি রাকাতে যেকোনো একটি সুরা পড়া অথবা অন্য বড় সুরা থেকে এ পরিমাণ কেরাত পাঠ করা। (নাসায়ি ১/১১৩, হাদিস : ৯৮২, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ২/১০৪, হাদিস : ২৬৭২)
৫. ফজরের প্রথম রাকাত দ্বিতীয় রাকাতের চেয়ে লম্বা করা। অন্যান্য ওয়াক্তে উভয় রাকাতে কেরাতের পরিমাণ সমান রাখা উচিত। (মুসলিম ১/১৮৬, হাদিস : ৪৫১, ৪৫২)
৬. কেরাত অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বা একেবারে ধীরগতিতে না পড়া, বরং মধ্যম গতিতে পড়া। (মুসলিম ১/২৫৩, হাদিস : ৭৩৩)
৭. ফরজ নামাজের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে শুধু সুরা ফাতিহা পড়া। (বুখারি ১/১০৭, হাদিস : ৭৭৬, মুসলিম শরিফ ১/১৮৫, হাদিস : ৪৫১)

 নামাজে বসার সুন্নাত ১৩টি

১.  বাঁ পা বিছিয়ে তার ওপর বসা। ডান পা সোজাভাবে দাঁড়িয়ে রাখা। উভয় পায়ের আঙুল সাধ্যমতো কিবলার দিকে মুড়িয়ে রাখা। (বুখারি ১/১১৪, হাদিস : ৮২৭, মুসলিম ১/১৯৪, ১৯৫, হাদিস : ৪৯৮) নারীরা বাঁ নিতম্বের ওপর বসবে এবং উভয় পা ডান দিকে বের করে কিবলামুখী করে মাটিতে বিছিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/২৭১, হাদিস : ২৮০৮, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৯, হাদিস : ৫০৭৫ সহিহ)
২.  উভয় হাত রানের ওপর হাঁটু বরাবর করে রাখা ও দৃষ্টি দুই হাঁটুর মাঝ বরাবর রাখা। (মুসলিম ১/২১৬, হাদিস : ৫৮০, আবু দাউদ ১/১৪২, হাদিস : ৯৯০) পুরুষরা হাতের আঙুল স্বাভাবিকভাবে রাখবে ও নারীরা মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/২৭০, হাদিস : ২৭৯৪ সহিহ)
৩.  ‘আশহাদু’ বলার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙুলির মাথা একসঙ্গে মিলিয়ে গোলাকার বৃত্ত বানানো এবং অনামিকা ও কনিষ্ঠাঙুলিদ্বয় মুড়িয়ে রাখা এবং (‘লা-ইলাহা’ বলার সময় শাহাদাত আঙুল সামান্য উঁচু করে ইশারা করা। অতঃপর ‘ইল্লাল্লাহু’ বলার সময় আঙুলের মাথা সামান্য ঝোঁকানো। হাঁটুর সঙ্গে না লাগানো)। (আবু দাউদ ১/১০৫, হাদিস : ৭২৬ সহিহ, নাসাঈ, হাদিস : ১২৭৩ হাসান)
৪.  শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর দরুদ শরিফ পাঠ করা। (বুখারি ১/৪৭৭, হাদিস : ৩৩৭০, তিরমিজি ২/১৮৬, হাদিস : ৩৪৭৭)
৫.  দরুদ শরিফের পর দোয়ায়ে মাসুরা পড়া। (বুখারি ১/১১৫, হাদিস : ৮৩৪/ তিরমিজি ১/১৩০, হাদিস : ৫৯৩)
৬.  উভয় দিকে সালাম ফেরানো। (মুসলিম ১/১৮১, হাদিস : ৫৮২, তিরমিজি, হাদিস : ২৯৫)
৭.  ডান দিকে আগে সালাম ফেরানো। উভয় সালাম কিবলার দিক থেকে শুরু করা ও সালামের সময় দৃষ্টি কাঁধের দিকে রাখা। (মুসলিম, হাদিস : ৫৮২)
৮.  ইমামের উভয় সালামে মুক্তাদি, ফেরেশতা ও নামাজি জিনদের প্রতি সালাম করার নিয়ত করা। (মুসলিম, হাদিস : ৪৩১)
৯. মুক্তাদিদের উভয় সালামে ইমাম, অন্যান্য মুসল্লি, ফেরেশতা ও নামাজি জিনদের প্রতি সালাম করার নিয়ত করা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৩১৪৯, ৩১৫২)
১০. একাকী নামাজি ব্যক্তি শুধু ফেরেশতাদের প্রতি সালাম করার নিয়ত করা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৩১৪০)
১১. মুক্তাদি ইমামের সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে সালাম ফেরানো। (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৮৩৮)
১২. ইমাম সালাম ফেরানোর সময় দ্বিতীয় সালাম প্রথম সালামের চেয়ে আস্তে বলা ও প্রথম সালাম অপেক্ষা দ্বিতীয় সালামে ‘মদ’ (টানা) কম করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৩০৫৭)
১৩. ইমামের দ্বিতীয় সালাম ফেরানো শেষ হলে মাসবুকের ছুটে যাওয়া নামাজ আদায়ের জন্য দাঁড়ানো। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৩১৫৬)

 যেসব কারণে অজু ভেঙে যায়

মৌলিকভাবে অজু ভঙ্গের কারণ সাতটি।
১.  পায়খানা ও প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু বের হওয়া। যেমন—বায়ু, প্রস্রাব-পায়খানা, পোকা ইত্যাদি। (হেদায়া-১/৭) ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে এলে (নামাজ পড়তে পবিত্রতা অর্জন করে নাও)। (সুরা মায়িদা, আয়াত ৬) আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, শরীর থেকে যা কিছু বের হয়, তার কারণে অজু ভেঙে যায়...।’ (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নম্বর : ৫৬৮)
২. রক্ত, পুঁজ বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া। (হেদায়া : ১/১০) আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.)-এর যখন নাক দিয়ে রক্ত ঝরত, তিনি ফিরে গিয়ে অজু করে নিতেন। (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ১১০)
৩.  মুখ ভরে বমি করা। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তির বমি হয় অথবা নাক দিয়ে রক্ত ঝরে বা মজি (সহবাসের আগে বের হওয়া সাদা পানি) বের হয়, সে ফিরে গিয়ে অজু করে নেবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর : ১২২১)
৪.  থুথুর সঙ্গে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হওয়া। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার থুথুতে রক্ত দেখে, থুথুতে রক্ত প্রবল না হলে তার ওপর অজু করা আবশ্যক হয় না।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নম্বর : ১৩৩০)
৫.  চিত বা কাত হয়ে হেলান দিয়ে ঘুম যাওয়া। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সিজদা অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ হয় না, তবে চিত হয়ে শুয়ে পড়লে ভেঙে যাবে, কেননা চিত বা কাত হয়ে শুয়ে পড়লে শরীর ঢিলে হয়ে যায়। (ফলে বাতকর্ম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর : ২৩১৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ২০২)
৬.  পাগল, মাতাল বা অচেতন হলে। হাম্মাদ (রহ.) বলেন, ‘যখন পাগল ব্যক্তি সুস্থ হয়, তখন নামাজের জন্য তার অজু করতে হবে।’ (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নম্বর : ৪৯৩)
৭.  নামাজে উচ্চৈঃস্বরে হাসি দিলে। ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজে উচ্চৈঃস্বরে হাসে, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ আবার আদায় করবে। হজরত হাসান বিন কুতাইবা (রহ.) বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে হাসি দেয়, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ আবার আদায় করবে।’ (সুনানে দারা কুতনি, হাদিস নম্বর : ৬১২)

 নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় ১১টি সুন্নাত

১. উভয় পায়ের আঙুলগুলো কিবলামুখী করে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানো। বিজ্ঞ ইমামদের গবেষণা মতে, পুরুষদের উভয় পায়ের মধ্যে নিম্নে চার আঙুল, ঊর্ধ্বে এক বিঘত পরিমাণ ফাঁকা রাখা হবে স্বাভাবিক পরিমাণ। (বুখারি ২/৯২৪, হাদিস : ৬২৫১, তিরমিজি ১/৬৬, হাদিস : ৩০৪ সহিহ)
    নারীরা উভয় পায়ের গোড়ালি মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/২৭০, হাদিস : ২৭৯৪ সহিহ)
২. তাকবিরে তাহরিমার সময় চেহারা কিবলার দিকে রেখে নজর সিজদার স্থানে রাখা ও হাত উঠানোর সময় মাথা না ঝোঁকানো। (মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৪৭৯, হাদিস : ১৭৬১ সহিহ, তিরমিজি ১/৬৬, হাদিস : ৩০৪ সহিহ)
৩. উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠানো। অর্থাৎ উভয় হাতের বৃদ্ধাঙুলির মাথা কানের লতি পর্যন্ত উঠানো। (মুসলিম শরিফ ১/১৬৮, হাদিস : ৩৯১)
    নারীরা তাদের হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও কাপড়ের ভেতর থেকে হাত বের করবে না। (তিরমিজি ১/২২২, হাদিস : ১১৭৩ সহিহ, তাবরানি কাবির ৯/১৪৪, হাদিস : ১৭৪৯৭ সহিহ)
৪. হাত উঠানোর সময় আঙুলগুলো ও হাতের তালু কিবলামুখী রাখা। (তিরমিজি ১/৫৬, হাদিস : ২৪০ সহিহ, তাবরানি আউসাত ৮/৪৪, হাদিস : ৭৮০১)
৫. আঙুলগুলো স্বাভাবিক রাখা, অর্থাৎ একেবারে মিলিয়েও না রাখা, আবার বেশি ফাঁকও না রাখা। (মুস্তাদরাক ১/২৩৪, হাদিস : ৮৫৬ সহিহ)
৬. ইমামের তাকবিরে তাহরিমা বলার পর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তাদির তাকবিরে তাহরিমা বলা। তবে যেন ইমামের তাকবিরে তাহরিমার আগে মুক্তাদির তাকবিরে তাহরিমার নিঃশ্বাস শেষ না হয়, তা লক্ষ রাখতে হবে। এরূপ হলে মুক্তাদির নামাজ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। (বুখারি ১/১০১, হাদিস : ৭৩৪, মুসলিম, হাদিস : ৪১৪)
৭. হাত বাঁধার সময় ডান হাতের তালু বাঁ হাতের পিঠের (পাতার) ওপর রাখা। (নাসায়ি শরিফ ১/১০২, হাদিস : ৮২৮ সহিহ)
৮. ান হাতের বৃদ্ধাঙুলি ও কনিষ্ঠাঙুলি দ্বারা গোলাকার বৃত্ত বানিয়ে বাঁ হাতের কবজি ধরা। (তিরমিজি ১/৫৯, হাদিস : ২৫২, নাসায়ি ১/১০২, হাদিস : ৮৮৬, ইবনে মাজাহ ১/৫৬, হাদিস : ৮১১, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/৩৪৩, হাদিস : ৩৯৪২)
৯. ওপরের ৮ নম্বরে উল্লিখিত হাদিসের আলোকে বিজ্ঞ ইমামরা বলেন, অবশিষ্ট তিন আঙুল বাঁ হাতের ওপর স্বাভাবিকভাবে বিছিয়ে রাখবে। নারীরা ডান হাতের তালু বাঁ হাতের পিঠের ওপর স্বাভাবিকভাবে রাখবে। পুরুষের মতো শক্ত করে ধরবে না।
১০. নাভির নিচে হাত বাঁধা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/৩৯০, হাদিস : ৩৯৫৯ সহিহ)
    নারীরা তাদের হাত ওড়নার ভেতরে (বুকের ওপর) রাখবে। (তিরমিজি ১/২২২, হাদিস : ১১৭৩ হাসান)
১১. ছানা পড়া। (আবু দাউদ, হাদিস : ৭৭৫, ৭৭৬ সহিহ)

 নামাজে রুকুর সুন্নাত আটটি

১. তাকবির বলা অবস্থায় রুকুতে যাওয়া। (বুখারি ১/১০৮, হাদিস : ৭৮৯)
২. উভয় হাত দ্বারা হাঁটু ধরা। (বুখারি ১/১০৯, হাদিস : ৭৯০)
৩. হাতের আঙুলগুলো ফাঁকা করে ছড়িয়ে রাখা। (আবু দাউদ-১/১০৬, হাদিস : ৭৩১ সহিহ, মুসনাদে আহমদ ৪/১২০, হাদিস : ১৭০৮৫ সহিহ)
    নারীরা উভয় হাত হাঁটুর ওপর স্বাভাবিকভাবে রাখবে, পুরুষদের মতো শক্ত করে ধরবে না এবং আঙুলগুলো মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৭, হাদিস : ৫০৬৯ সহিহ)
৪. উভয় হাত সম্পূর্ণ সোজা রাখা, কনুই বাঁকা না করা। (আবু দাউদ ১/১০৭, হাদিস : ৭৩৪ হাসান)
    নারীরা তাদের উভয় বাহু পাঁজরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৭, হাদিস : ৫০৬৯ সহিহ)
৫. পায়ের গোছা, হাঁটু ও ঊরু সম্পূর্ণ সোজা রাখা। হাঁটু সামনের দিকে বাঁকা না করা। (আবু দাউদ ১/১২৫, হাদিস : ৮৬৩ হাসান, মুসনাদে আহমদ ৪/১১৯, হাদিস : ১৭০৮০ সহিহ)
৬. মাথা, পিঠ ও কোমর সমান রাখা, উঁচু-নিচু না করা। (বুখারি শরিফ ১/১১৪, হাদিস : ৮২৮ মুসলিম শরিফ ১/১৯৪, হাদিস : ৪৯৮) নারীরা রুকুতে পুরুষদের তুলনায় কম ঝুঁকবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৭, হাদিস : ৫৬৯ সহিহ)
৭. রুকুতে কমপক্ষে তিনবার রুকুর তাসবিহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম) পড়া। (আবু দাউদ ১/১২৯, হাদিস : ৮৮৬ সহিহ ইবনে খুজায়মা ১/৩৩৪, হাদিস : ৬৬৮ হাসান লিগাইরিহি)
৮. রুকু থেকে ওঠার সময় ইমাম ‘সামি’আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ ও মুক্তাদি ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ এবং একাকী নামাজ আদায়কারী উভয়টি বলা। (বুখারি শরিফ ১/১০১, হাদিস : ৭৩৩, ৭৮৯)
    বি. দ্র. : রুকু থেকে উঠে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে এক তাসবিহ পরিমাণ স্থিরভাবে দাঁড়ানো জরুরি। (বুখারি শরিফ ১/১১০, হাদিস : ৮০১, ৮০২)

 নামাজে সিজদার সুন্নাত ১২টি

১. তাকবির বলা অবস্থায় সিজদায় যাওয়া। (বুখারি শরিফ ১/১১০, হাদিস : ৮০৩)
    (সিজদায় যাওয়া ও সিজদা থেকে দাঁড়ানোর সময় তাকবির এক আলিফ থেকে অধিক টানা উচিত নয়। অবশ্য হাদর এবং তারতিলের পার্থক্য থাকবে)। (শামি ১:৪৮০)
২. প্রথমে উভয় হাঁটু মাটিতে রাখা। (নাসায়ি ২/২০৬, হাদিস : ১০৮৯, আবু দাউদ ১/১২২, হাদিস : ৮৩৮ সহিহ লিগাইরিহি)
৩. তারপর হাঁটু থেকে আনুমানিক এক হাত দূরে উভয় হাত রাখা এবং হাতের আঙুলগুলো কিবলামুখী করে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে রাখা। (বুখারি শরিফ ১/১১৪, হাদিস : ৮২৮, সহিহ ইবনে খুজায়মা ১/৩২৪, হাদিস : ৬৪২ হাসান)
    নারীরা অত্যন্ত জড়সড় ও সংকুচিত হয়ে সিজদা করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/২৪২, হাদিস : ২৭৭৭ সহিহ)
৪. তারপর উভয় বৃদ্ধাঙুলির মাথা বরাবর নাক রাখা। (মুসনাদে আহমাদ ৪/৩১৮, হাদিস : ১৮৮৯৪ সহিহ)
৫. তারপর কপাল রাখা। (মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৭, হাদিস : ১৮৮৮০ সহিহ)
৬.  অতঃপর দুই হাতের মাঝে সিজদা করা ও দৃষ্টি নাকের অগ্রভাগের দিকে রাখা। (মুসলিম ১/১৭৩, হাদিস : ৪০১/ মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৪৭৯, হাদিস : ১৭৬১ সহিহ)
৭. সিজদায় পেট ঊরু থেকে পৃথক রাখা। (মুসলিম ১/১৯৪, হাদিস : ৪৯৬, আবু দাউদ ১/১০৭, হাদিস : ৭৩৫ হাসান)
    নারীরা উভয় রানের সঙ্গে পেট মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/২৪২, হাদিস : ২৭৭৭ সহিহ)
৮. পাঁজরদ্বয় থেকে উভয় বাহু পৃথক রাখা। (বুখারি ১/১১২, হাদিস : ৮০৭)
    নারীরা বাহুদ্বয় যথাসাধ্য পাঁজরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/১৩৮, হাদিস : ২৭৮১ সহিহ)
৯. কনুই মাটি ও হাঁটু থেকে পৃথক রাখা। (বুখারি ১/১১৩, হাদিস : ৮২২)
    নারীরা কনুই মাটিতে মিলিয়ে রাখবে এবং পায়ের পাতাগুলো দাঁড়ানো না রেখে (ডান দিকে বের করে) মাটিতে বিছিয়ে রাখবে আর আঙুলগুলো যথাসাধ্য কিবলামুখী রাখবে। (মারাসিলে আবি দাউদ ১১৯, হাদিস : ৮৭ সহিহ)
১০. সিজদায় কমপক্ষে তিনবার সিজদার তাসবিহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) পড়া। (আবু দাউদ : ১/৫৪২, হাদিস : ৮৭০ হাসান)
১১. তাকবির বলা অবস্থায় সিজদা থেকে ওঠা। (বুখারি ১/১১৪, হাদিস : ৮২৫)
১২. প্রথমে কপাল, (তারপর নাক) তারপর উভয় হাত, তারপর উভয় হাঁটু উঠানো। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ২/১৭৭, হাদিস : ২৯৫৮ সহিহ)
বি. দ্র. : দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যাওয়ার সময় হাঁটু মাটিতে লাগার আগ পর্যন্ত বুক সম্পূর্ণ সোজা রাখা জরুরি। অপারগতা ছাড়া বুক ঝুঁকিয়ে সিজদায় গেলে একাধিক রুকু হয়ে সুন্নাতবিরোধী হবে। দুই সিজদার মধ্যে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে এক তাসবিহ পরিমাণ স্থির হয়ে বসা জরুরি। 

সূত্র ঃ  মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ, কালের কন্ঠ 

(সাহাবাদের আমল থেকে উদ্ধৃত)

0 comments:

Post a Comment