বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া
দার্শনিকভাবে দেখলে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া, স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল ইনসানু মা গার্রাকা বি রাব্বিকাল কারিম’ অর্থাত্ ‘হে, মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহিমান্বিত রব সম্পর্কে উদাসীন করল?’ (আল কোরআন ৮২:৬)।
সত্যিকার অর্থেই বেশির ভাগ মানুষ বাস্তবে স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় নাস্তিকের সংখ্যা অনেক। রাশিয়া আগে অফিসিয়ালি নাস্তিক ছিল। এখনও সেখানে নাস্তিকতার হার কম নয় বরং অনেক হবে। অন্যদিকে যারা বিশ্বাসী বলে দাবি করে তাদের মধ্যেও অনেকে সন্দেহবাদী (ংশবঢ়ঃরপ)। অর্থাত্ বলবে না স্রষ্টা নেই। কিন্তু বাস্তবে স্রষ্টাকে স্মরণ করবে না বা তার আদেশ মেনে চলবে না। স্রষ্টাকে মেনে চলে, এ রকম লোকের সংখ্যা খুব কম।
খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে স্রষ্টার কার্যকর আনুগত্য কম। সে তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ভালো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নাস্তিক নেই বললেই চলে এবং যারা বিশ্বাসী তারা কোনো না কোনো পর্যায়ে আমল করে। যারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করেন, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আমল করেন। তারাও নামাজ পড়েন, ইফতার করেন, সাহরি খান, হালাল-হারাম দেখে চলেন। তারাও কুরবানি, হজ, ওমরা ও ঈদ পালন করেন। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের অনুশীলন তুলনামূলক ভালো।
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার ফলে দুটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা, আরেকটি হলো গোঁড়া সেক্যুলারিজম। সেটিও স্রষ্টাকে প্রায় অস্বীকার করার কাছাকাছি একটি অবস্থা। বিশ্ব সঙ্কটের মূলে কাজ করছে এ দুটি—একদিকে বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা এবং অন্যদিকে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সেক্যুলারিজমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষায় রয়েছে সেক্যুলারিজমের গভীর ছাপ। ইউরোপের পণ্ডিতরা এমনকি বর্তমানে মুসলমান বিজ্ঞানীরাও তাদের বইগুলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু করে না। কিন্তু মুসলমানরা যখন বিজ্ঞানে উন্নতি করল (চীন ও ভারত থেকে গ্রহণ করে), তখন তারা অনেক দিকে বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটাল। সে সময় ওইসব মুসলমান তাদের বিজ্ঞানের প্রত্যেক বই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু করতেন। তারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন গভীরভাবে। কিন্তু ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসী না হওয়ায় (অথবা সেক্যুলার হওয়ায় কিংবা স্রষ্টায় বিশ্বাস করা তাদের কাছে একটি লজ্জার বিষয় হওয়ায়) তারা স্রষ্টার কথা উল্লেখ করেন না। আমাদের মুসলিম বিজ্ঞানীরা এটি এখন লিখতে পারেন; কিন্তু তারাও লিখছেন না। এখন না লেখার রেওয়াজ হয়ে গেছে। অথচ আগে লেখাটাই রীতি ছিল।
এখন বিজ্ঞানের বইগুলোতে আল্লাহ বা গড শব্দের উল্লেখ নেই। স্রষ্টা (পত্বধঃড়ত্) শব্দটি লেখা হয় না। এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার। কোথাও কোথাও প্রকৃতি (ঘধঃঁত্ব) শব্দের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই প্রকৃতি কী সেটি একবারে স্পষ্ট নয়। তারা একবারও ভাবে না যে, এসব প্রাকৃতিক আইন আছে কীভাবে, আইন প্রণেতা ছাড়া কি কোনো আইন হয়? তারা নাকি খুব যুক্তিবাদী, কিন্তু আমি তো কোনো যুক্তি দেখছি না।
আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ভালো দিক আছে, অনেক অবদান আছে তা আমরা মানি। কিন্তু এর পেছনে কাজ করছে এমন একটি মন যেটি স্রষ্টার প্রশ্নে, আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়বাদিতায় ভুগছে। স্রষ্টাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দিচ্ছে না; আল্লাহর নাম উল্লেখ করছে না; এটি উল্লেখ করা সভ্যতাবিরোধী মনে করছে, এটি একটি পশ্চাত্পদ ব্যাপার মনে করছে। এই যে ধারণা এটা আমাদের কালচারকে খারাপ করে ফেলছে। আমাদের কালচারে সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার প্রভাব পড়েছে।
সমাজবিজ্ঞানেরও একই রকম অবস্থা। সমাজতত্ত্ব ধরেই নেবে যে ধর্ম একটি মানবসৃষ্ট বিষয়। অথচ সমাজবিজ্ঞানীরা এভাবে দেখাতে পারতেন যে, স্রষ্টাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন; আমাদের একটি সামাজিক প্রবণতা বা সামাজিক মন দিয়েছেন। স্রষ্টার সার্বিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আমাদের মধ্যে সমাজবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা রয়েছে। এজন্য আমরা একতাবদ্ধ হই এবং সমাজ গঠন করি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যান্য ডিসিপ্লিনেরও একই অবস্থা। যেমন—নৃবিজ্ঞানও স্বীকার করছে না যে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এটিকে বিজ্ঞানীরা একেবারেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। নৃবিজ্ঞান মানব সৃষ্টির ইতিহাস বের করার চেষ্টা করেছে মাটি খুঁড়ে বের করা হাড় এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক চিহ্ন থেকে। এসব থেকে তারা যে ইতিহাস লিখছে তাতে তারা বলছে, মানুষ এমনি এমনিই হয়েছে; কোনো স্রষ্টা নেই।
এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, দারিদ্র্য বিশ্বের একটি বড় সঙ্কট, দারিদ্র্যের কারণে মানুষের একটি বিরাট অংশ ভালো হতে পারে না। এ সঙ্কটের মূলেও রয়েছে ওই আল্লাহকে না মানা, বস্তুবাদ এবং সেক্যুলারিজম। মানুষ বস্তুবাদী হয়ে গেছে। গরিবের জন্য, দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা সে উপলব্ধি করছে না। অনেকেই দারিদ্র্য দূর করার জন্য ওয়াদা করে থাকে। আসলে তারা ওয়াদা করার জন্য ওয়াদা করে, কথা বলার জন্য বলে। সত্যিই কি কার্যকরভাবে তারা এগুলো চায়? বিশেষ করে দেশের পুঁজিবাদীরা এগুলো চায় না বলেই মনে হয়। কারণ পুঁজিবাদের তত্ত্বে গরিবের কথা নেই। প্রফিটের কথা আছে, মুক্তবাজারের কথা আছে। সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বাজারের বিকৃতি (গধত্শবঃ ফরংঃড়ত্ঃরড়হ) দূর করার কথা পুঁজিবাদ তত্ত্বের কোথাও নেই। গরিবের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে—এটা পুঁজিবাদের কোথাও বলা নেই। যদিও এটা এখন পুঁজিবাদী দেশে করা হচ্ছে, কিন্তু তারা এ ব্যবস্থা পুঁজিবাদের কাঠামো থেকে বের হয়ে এসেই নিচ্ছে। উপনিবেশবাদ (ঈড়ষড়হরধষরংস) এবং সাম্রাজ্যবাদও (ওসঢ়বত্রধষরংস) এসেছে বস্তুবাদ থেকেই। নিজের ভোগ ও জাতির ভোগের প্রেরণা থেকেই এসবের উত্পত্তি। এ সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে শোষণ (বীঢ়ষড়রঃ) করা। এই যে বস্তুবাদী স্বার্থপরতা এবং পুঁজিবাদ—এসব পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। এ সবকিছু মিলে মানুষকে দায়িত্বহীন বানিয়েছে, তাকে ভোগবাদী করে তুলেছে। দায়িত্বশীল কাদের বলা যেতে পারে? যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং দুনিয়াকে শোষণ করে না।
সুতরাং সব সমস্যার মূল কারণ যদি বলা হয় তাহলে আমি বলব, ‘স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া’। এজন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলরা আহ্বান করেছেন আল্লাহকে মানো এবং বলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাত্, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে মানুষের মধ্যে স্রষ্টার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। মুসলিমদের এমনকি অমুসলিমদের জন্যও বলব, যে কোনো র্ধমের প্রতি বিশ্বাস নাস্তিকতা থেকে ভালো। প্রত্যেক ধর্মের একটা এথিক্স বা নীতিবোধ আছে। নাস্তিকতার কোনো নীতিবোধ নেই। এটি তো নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে। নাস্তিক বিশ্বাস করে যে তার কোনো বিচার হবে না, তার কোনো জবাবদিহিতা নেই; সুতরাং দুনিয়ায় যা ইচ্ছা সে করতে পারে। এ ধরনের লোক সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। এজন্য সবার মধ্যে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহকে চেনাতে হবে যতদূর সম্ভব। সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবেই সমাজ তথা বিশ্ব থেকে স্বার্থপরতা দূর হতে পারে, সমাজের মূল রোগ তথা মূল সমস্যা দূর হতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
(আমার দেশ, ০৭/১২/২০১৩)
সত্যিকার অর্থেই বেশির ভাগ মানুষ বাস্তবে স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় নাস্তিকের সংখ্যা অনেক। রাশিয়া আগে অফিসিয়ালি নাস্তিক ছিল। এখনও সেখানে নাস্তিকতার হার কম নয় বরং অনেক হবে। অন্যদিকে যারা বিশ্বাসী বলে দাবি করে তাদের মধ্যেও অনেকে সন্দেহবাদী (ংশবঢ়ঃরপ)। অর্থাত্ বলবে না স্রষ্টা নেই। কিন্তু বাস্তবে স্রষ্টাকে স্মরণ করবে না বা তার আদেশ মেনে চলবে না। স্রষ্টাকে মেনে চলে, এ রকম লোকের সংখ্যা খুব কম।
খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে স্রষ্টার কার্যকর আনুগত্য কম। সে তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ভালো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নাস্তিক নেই বললেই চলে এবং যারা বিশ্বাসী তারা কোনো না কোনো পর্যায়ে আমল করে। যারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করেন, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আমল করেন। তারাও নামাজ পড়েন, ইফতার করেন, সাহরি খান, হালাল-হারাম দেখে চলেন। তারাও কুরবানি, হজ, ওমরা ও ঈদ পালন করেন। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের অনুশীলন তুলনামূলক ভালো।
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার ফলে দুটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা, আরেকটি হলো গোঁড়া সেক্যুলারিজম। সেটিও স্রষ্টাকে প্রায় অস্বীকার করার কাছাকাছি একটি অবস্থা। বিশ্ব সঙ্কটের মূলে কাজ করছে এ দুটি—একদিকে বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা এবং অন্যদিকে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।
স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়ার প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সেক্যুলারিজমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষায় রয়েছে সেক্যুলারিজমের গভীর ছাপ। ইউরোপের পণ্ডিতরা এমনকি বর্তমানে মুসলমান বিজ্ঞানীরাও তাদের বইগুলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু করে না। কিন্তু মুসলমানরা যখন বিজ্ঞানে উন্নতি করল (চীন ও ভারত থেকে গ্রহণ করে), তখন তারা অনেক দিকে বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটাল। সে সময় ওইসব মুসলমান তাদের বিজ্ঞানের প্রত্যেক বই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু করতেন। তারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন গভীরভাবে। কিন্তু ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসী না হওয়ায় (অথবা সেক্যুলার হওয়ায় কিংবা স্রষ্টায় বিশ্বাস করা তাদের কাছে একটি লজ্জার বিষয় হওয়ায়) তারা স্রষ্টার কথা উল্লেখ করেন না। আমাদের মুসলিম বিজ্ঞানীরা এটি এখন লিখতে পারেন; কিন্তু তারাও লিখছেন না। এখন না লেখার রেওয়াজ হয়ে গেছে। অথচ আগে লেখাটাই রীতি ছিল।
এখন বিজ্ঞানের বইগুলোতে আল্লাহ বা গড শব্দের উল্লেখ নেই। স্রষ্টা (পত্বধঃড়ত্) শব্দটি লেখা হয় না। এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার। কোথাও কোথাও প্রকৃতি (ঘধঃঁত্ব) শব্দের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই প্রকৃতি কী সেটি একবারে স্পষ্ট নয়। তারা একবারও ভাবে না যে, এসব প্রাকৃতিক আইন আছে কীভাবে, আইন প্রণেতা ছাড়া কি কোনো আইন হয়? তারা নাকি খুব যুক্তিবাদী, কিন্তু আমি তো কোনো যুক্তি দেখছি না।
আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ভালো দিক আছে, অনেক অবদান আছে তা আমরা মানি। কিন্তু এর পেছনে কাজ করছে এমন একটি মন যেটি স্রষ্টার প্রশ্নে, আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়বাদিতায় ভুগছে। স্রষ্টাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দিচ্ছে না; আল্লাহর নাম উল্লেখ করছে না; এটি উল্লেখ করা সভ্যতাবিরোধী মনে করছে, এটি একটি পশ্চাত্পদ ব্যাপার মনে করছে। এই যে ধারণা এটা আমাদের কালচারকে খারাপ করে ফেলছে। আমাদের কালচারে সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার প্রভাব পড়েছে।
সমাজবিজ্ঞানেরও একই রকম অবস্থা। সমাজতত্ত্ব ধরেই নেবে যে ধর্ম একটি মানবসৃষ্ট বিষয়। অথচ সমাজবিজ্ঞানীরা এভাবে দেখাতে পারতেন যে, স্রষ্টাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন; আমাদের একটি সামাজিক প্রবণতা বা সামাজিক মন দিয়েছেন। স্রষ্টার সার্বিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আমাদের মধ্যে সমাজবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা রয়েছে। এজন্য আমরা একতাবদ্ধ হই এবং সমাজ গঠন করি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যান্য ডিসিপ্লিনেরও একই অবস্থা। যেমন—নৃবিজ্ঞানও স্বীকার করছে না যে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এটিকে বিজ্ঞানীরা একেবারেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। নৃবিজ্ঞান মানব সৃষ্টির ইতিহাস বের করার চেষ্টা করেছে মাটি খুঁড়ে বের করা হাড় এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক চিহ্ন থেকে। এসব থেকে তারা যে ইতিহাস লিখছে তাতে তারা বলছে, মানুষ এমনি এমনিই হয়েছে; কোনো স্রষ্টা নেই।
এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, দারিদ্র্য বিশ্বের একটি বড় সঙ্কট, দারিদ্র্যের কারণে মানুষের একটি বিরাট অংশ ভালো হতে পারে না। এ সঙ্কটের মূলেও রয়েছে ওই আল্লাহকে না মানা, বস্তুবাদ এবং সেক্যুলারিজম। মানুষ বস্তুবাদী হয়ে গেছে। গরিবের জন্য, দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা সে উপলব্ধি করছে না। অনেকেই দারিদ্র্য দূর করার জন্য ওয়াদা করে থাকে। আসলে তারা ওয়াদা করার জন্য ওয়াদা করে, কথা বলার জন্য বলে। সত্যিই কি কার্যকরভাবে তারা এগুলো চায়? বিশেষ করে দেশের পুঁজিবাদীরা এগুলো চায় না বলেই মনে হয়। কারণ পুঁজিবাদের তত্ত্বে গরিবের কথা নেই। প্রফিটের কথা আছে, মুক্তবাজারের কথা আছে। সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বাজারের বিকৃতি (গধত্শবঃ ফরংঃড়ত্ঃরড়হ) দূর করার কথা পুঁজিবাদ তত্ত্বের কোথাও নেই। গরিবের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে—এটা পুঁজিবাদের কোথাও বলা নেই। যদিও এটা এখন পুঁজিবাদী দেশে করা হচ্ছে, কিন্তু তারা এ ব্যবস্থা পুঁজিবাদের কাঠামো থেকে বের হয়ে এসেই নিচ্ছে। উপনিবেশবাদ (ঈড়ষড়হরধষরংস) এবং সাম্রাজ্যবাদও (ওসঢ়বত্রধষরংস) এসেছে বস্তুবাদ থেকেই। নিজের ভোগ ও জাতির ভোগের প্রেরণা থেকেই এসবের উত্পত্তি। এ সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে শোষণ (বীঢ়ষড়রঃ) করা। এই যে বস্তুবাদী স্বার্থপরতা এবং পুঁজিবাদ—এসব পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। এ সবকিছু মিলে মানুষকে দায়িত্বহীন বানিয়েছে, তাকে ভোগবাদী করে তুলেছে। দায়িত্বশীল কাদের বলা যেতে পারে? যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং দুনিয়াকে শোষণ করে না।
সুতরাং সব সমস্যার মূল কারণ যদি বলা হয় তাহলে আমি বলব, ‘স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া’। এজন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলরা আহ্বান করেছেন আল্লাহকে মানো এবং বলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাত্, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে মানুষের মধ্যে স্রষ্টার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। মুসলিমদের এমনকি অমুসলিমদের জন্যও বলব, যে কোনো র্ধমের প্রতি বিশ্বাস নাস্তিকতা থেকে ভালো। প্রত্যেক ধর্মের একটা এথিক্স বা নীতিবোধ আছে। নাস্তিকতার কোনো নীতিবোধ নেই। এটি তো নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে। নাস্তিক বিশ্বাস করে যে তার কোনো বিচার হবে না, তার কোনো জবাবদিহিতা নেই; সুতরাং দুনিয়ায় যা ইচ্ছা সে করতে পারে। এ ধরনের লোক সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। এজন্য সবার মধ্যে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহকে চেনাতে হবে যতদূর সম্ভব। সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবেই সমাজ তথা বিশ্ব থেকে স্বার্থপরতা দূর হতে পারে, সমাজের মূল রোগ তথা মূল সমস্যা দূর হতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
(আমার দেশ, ০৭/১২/২০১৩)
0 comments:
Post a Comment