Tuesday, March 11, 2014

চির বসন্তের স্বাদ মন ভরে উপভোগ করে আল্লাহপ্রেমিক

চির বসন্তের স্বাদ মন ভরে উপভোগ করে আল্লাহপ্রেমিক
মাহমুদ আহমদ সুমন
প্রকাশ : ০৭ মার্চ, ২০১৪

ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য ঋতু বসন্ত। তাইতো বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। কবির ভাষায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি ডাকে’। যদিও ফুল সব ঋতুতেই ফোটে আর সব ঋতুতেই পাখি গায়। কিন্তু বসন্তে ফুলের রং, বাহার যেমন ভিন্ন হয় তেমনি বসন্তদূত কোকিলের কুহুতানও যেন ভিন্ন এক প্রকৃতিকে উপহার দেয়। বসন্ত এলে প্রকৃতিতে লাগে রং বদলের ছোঁয়া আর পাতা ঝরার দিন শেষ হয়ে যায়। ধূসর প্রকৃতির ঠোঁটে ফোটে হাসি। প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নতুন জীবন। আসলে বসন্তের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিবিড়। যেভাবে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ দেখতে পাও। এরপর আমরা যখন এর ওপর পানি বর্ষণ করি তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ও ফেঁপে-ফুলে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভামণ্ডিত জোড়া উৎপন্ন করে।’ (সূরা হজ : ৫)।
আল্লাহতায়ালার জান্নাতের বসন্ত নির্দিষ্ট কোনো মাস নয় বরং বছরের প্রত্যেকটি দিনই বসন্ত। যারা পৃথিবীর ভোগবিলাসে মগ্ন না হয়ে আল্লাহর প্রেমে মগ্ন থাকে কেবল তারাই কেবল আল্লাহপাকের সেই চির বসন্তের স্বাদ উপভোগ করার তৌফিক লাভ করেন। আল্লাহপাক তার প্রিয়দের জান্নাতের চির বসন্তে চিরকাল থাকার প্রতিশ্র“তিও দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের এমন সব বাগানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন যেগুলোর পাদদেশ দিয়ে নদ-নদী বয়ে যাবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর তিনি তাদের চিরস্থায়ী বাগানসমূহে পবিত্র গৃহেরও প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটাই মহান সফলতা।’ (সূরা তাওবা : ৭১)। অপর এক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যাদের সৌভাগ্যবান সাব্যস্ত করা হয়েছে তারা জান্নাতে থাকবে। আকাশসমূহ ও পৃথিবী যতদিন স্থায়ী থাকবে তারা সেখানে ততদিন অবস্থান করবে। তবে তোমার প্রভু-প্রতিপালক অন্যকিছু চাইলে সে কথা ভিন্ন। এ হবে এক নিরবচ্ছিন্ন দান।’ (সূরা হুদ : ১০৮)।
পবিত্র কোরআনের শিক্ষানুযায়ী জান্নাত বা বেহেশত চিরস্থায়ী তবে দোজখ বা জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী নয় বরং ক্ষণস্থায়ী। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেছেন, আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, জাহান্নামের ওপর এমন এক সময় আসবে যখন এর দরজাগুলো বাতাসে খট খটাতে থাকবে এবং এর মধ্যে কোনো লোক অবশিষ্ট থাকবে না। এর অধিবাসীরা এতে বহু শতাব্দী থাকার পর এমন ঘটবে। (মুসনাদ)। এই হাদিস অনুযায়ী জাহান্নাম সম্বন্ধে ‘খালেদিনা’ শব্দ শতশত বছর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ব্যাপারে হজরত আবদুল্লাহ বিন উমর, হজরত জাবির (রা.) ও হজরত ইমাম হাম্বলও (রহ.) একমত প্রকাশ করেছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকেও এই হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (বোখারি) বিখ্যাত ওলামায়ে কেরামের মধ্যে ইবনে তাঈমিয়া এবং ইবনে কাইয়্যিম লিখেছেন ‘যদিও দুষ্ট প্রকৃতিবিশিষ্ট অবিশ্বাসীদের চিরকাল জাহান্নামে থাকা উচিত, একদিন আল্লাহর অসীম করুণাবলে দোজখই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে এবং যখন জাহান্নামই থাকবে না তখন এর নিবাসীও থাকবে না।’ (ফাতহ)।
পবিত্র কোরআনে জান্নাত সম্পর্কে বলা হয়েছে এর পুরস্কার কখনও শেষ হবে না কিন্তু জাহান্নাম সম্পর্কে এ ধরনের কোনো শব্দাবলী পাওয়া যায় না। তাই এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহতায়ালার জান্নাত হচ্ছে চির বসন্ত। আল্লাহপাকের জান্নাতের বাগান কতই না চমৎকার হবে যেখানে বছরের বার মাসই বসন্ত আর এর সৌন্দর্য আমাদের ভাবনার ঊর্ধ্বে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের কৃতকর্মের প্রতিদানরূপে চোখ জুড়ানো কত কী যে তাদের জন্য গোপন করে রাখা হয়েছে তা কেউই জানে না।’ (৩২ : ২৭)। জান্নাত বা বেহেশতের আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এত নেয়ামত তৈরি করেছি যে, কোনো চোখ তা দেখেনি, কোনো কান তা শোনেনি, বরং কোনো মানুষের হৃদয়েও তার ধারণা জন্মেনি।’ (বোখারি, কিতাবুল বাদউল খালক)। মহানবী (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী পরকালীন জীবনের অনুগ্রহগুলো পার্থিব বস্তুর মতো নয়। ধর্মপরায়ণ ও বিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তিদের ইহজীবনের প্রতিটি সৎ কাজের জন্য আধ্যাত্মিক তৃপ্তিদায়ক আশীর্বাদ তাদের সামনে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহপাকের নেক বান্দাদের তিনি সেদিন এমন পুরস্কার প্রদান করবেন যা মানুষ ইহজীবনে কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহতায়ালার এই চির বসন্তের বাগানে কেবল শান্তিপ্রাপ্ত আত্মারাই বিচরণ করবে। যেভাবে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস। অর্থাৎ তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সূরা ফাজর : ২৭-৩০)। অপর এক স্থানে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তাদের এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নদ-নদী বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল। সাবধান! আল্লাহর দলই সফল হবে।’ (সূরা মুজাদেলা : ২২)। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মুমিনের আত্মা পৌঁছে তখনই আল্লাহপাক তাকে চিরকালের জান্নাতের বসন্তে বসবাসের জন্য আহ্বান জানান। যেভাবে অপর এক স্থানে আল্লাহপাক বলেন, ‘এরাই জান্নাতের অধিবাসী। এদের কৃতকর্মের প্রতিদান হিসেবে এরা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সূরা আহকাফ : ১৪)।
আসলে ‘শান্তিপ্রাপ্ত আত্মার অবস্থা হল জান্নাতি অবস্থা, যে অবস্থায় সে সব মানবীয় দুর্বলতা ও দোষের ঊর্ধ্বে উঠে যায় এবং এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠে। সে আল্লাহর সঙ্গে একীভূত ও বিলীন হয়ে যায়, আল্লাহ ছাড়া সে বাঁচতেই পারে না। এই যে পরিবর্তন তা কিন্তু ইহলোকে পূর্ণ কর্ম করার ফলেই তার মাঝে ঘটে, যার ফলে ইহকালেই সে চির বসন্তের জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করে। আর এ ধরনের মুমিনকে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মৃত্যুর আগেই বলা হবে, ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস।’
আমরা যদি আল্লাহতায়ালার জান্নাতের চির বসন্তের স্বাদ লাভ করতে চাই তাহলে আমাদেরও শান্তিপ্রাপ্ত আত্মার সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে আর এর জন্য আমাদের আল্লাহওয়ালা হতে হবে, তার নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তার চির বসন্তের বাগানের অধিবাসী হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন।
সূত্র - দৈনিক যুগান্তর

0 comments:

Post a Comment