গরিবের হক কুরবানির চামড়া নিয়ে বিপুল বাণিজ্য
সরকারের নির্লিপ্ততায় এতিম মিসকিনের মাথায় বাড়ি
কোরবানির পশুর
চামড়ার দাম গতবারের
চেয়েও কমিয়ে নির্ধারণ
করলেন ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে
দরপতন আর দেশে
লবণের চড়া মূল্যের
কথা বলে দাম
কমিয়ে ধরা হলেও
বাস্তবতা হলো,
লবণের খরচ ট্যানারি
মালিক কিংবা চামড়াজাত
পণ্য রপ্তানিকারকদের পকেট
থেকে যায় না। নীচের চার্ট দেখি :-
তা
সত্ত্বেও ঢাকায়
কোরবানির গরুর
লবণযুক্ত চামড়ার
দাম ধরা হয়েছে
বর্গফুটে সর্বোচ্চ
৫০ টাকা, ঢাকার
বাইরে ৪০ টাকা। আর
সারা দেশে লবণযুক্ত
খাসির চামড়া প্রতি
বর্গফুট ২০
টাকা, ছাগলের চামড়া
১৫ টাকা।
কোরবানির পশুর
চামড়া বিক্রির অর্থ
সাধারণত এতিমখানা,
লিল্লাহ বোর্ডিংসহ
সমাজের গরিব-দুঃখী
মানুষের মধ্যে
বিতরণ করা হয়।
ফলে চামড়ার দাম
কমে গেলে এসব
দুস্থ-অসহায় মানুষের
ভাগে টাকা কম
পড়বে।
কয়েক বছর
ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে
দরপতন ও চাহিদা
কমার অজুহাত তুলে
কোরবানির পশুর
চামড়ার দাম কমিয়ে
নির্ধারণ করছেন
ট্যানারি মালিক,
চামড়া ও চামড়াজাত
পণ্যের রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট
ব্যবসায়ীরা। অথচ
পরিসংখ্যান বলছে,
গত ফেব্রুয়ারি থেকে
জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক
বাজারে চামড়ার দর
অপরিবর্তিত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে
প্রতি পাউন্ড চামড়ার
মূল্য ৭০ সেন্ট।
বাংলাদেশের চামড়ার
মান বিশ্বে এক
নম্বর। অর্থাৎ এ
দেশের পশুর চামড়ার
দামও আন্তর্জাতিক বাজারে
বেশি। ভারতের গরুর
চামড়ার মান অনেক
নিম্নমানের। ভারতে
বর্তমানে প্রতি
বর্গফুট গরুর
কাঁচা চামড়ার মূল্য
প্রায় ৯০ টাকা,
যা বাংলাদেশের নির্ধারিত
দরের প্রায় দ্বিগুণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন,
ট্যানারি শিল্প
সাভারে স্থানান্তরিত না
হয়ে উচ্চ আদালতের
আদেশে প্রতিদিন যে
সরকারকে ১০
হাজার টাকা করে
জরিমানা দিতে
হচ্ছে, চামড়ার দাম
কমিয়ে নির্ধারণ করে
ওই অর্থও উসুল
করে নিচ্ছেন তাঁরা।
ভারতের তুলনায়
বাংলাদেশের চামড়ার
মান ভালো অথচ
বাংলাদেশের তুলনায়
ভারতে চামড়ার দাম
অনেক বেশি থাকায়
প্রতিবছরই দেশটিতে
চামড়া পাচার হওয়ার
আশঙ্কা থাকে। পাচার
ঠেকাতে দেশের ভেতরে
কাঁচা চামড়ার দাম
না বাড়িয়ে ট্যানারি
মালিকরা বরাবরই
সীমান্তে কড়াকড়ি
আরোপের আরজি জানান।
কয়েক বছর ধরে
বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর
সদস্যরা সীমান্তে
নজরদারি জোরদার
করায় বাংলাদেশ থেকে
ভারতে চামড়া পাচার
কমে গেছে। ফলে
দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে
পাচারের ভয়
ব্যবসায়ীদের আগের
মতো ভাবায় না।
চামড়াশিল্পের ব্যবসায়ীদের
দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,
কোরবানির সময়
প্রায় এক কোটি
পশুর চামড়া সংগ্রহ
করেন তাঁরা। এটি
দেশের মোট চামড়ার
প্রায় ৬০ শতাংশ।
কোরবানির পশুর
চামড়া কিনতে তাঁদের
খরচ হবে প্রায়
দেড় হাজার কোটি
টাকা। সারা বছর
বাকি ৪০ শতাংশ
চামড়ার জোগান পেতে
আরো এক হাজার
কোটি টাকার চামড়া
কিনতে হবে। অর্থাৎ
বছরে প্রায় আড়াই
হাজার কোটি টাকার
কাঁচা চামড়া কেনেন
শিল্প মালিকরা। এসব
চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে
২০ শতাংশ খরচ
করতে হয়। তাতে
মোট খরচ পড়ে
৫০০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ চামড়া কেনা
ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায়
তিন হাজার কোটি
টাকা খরচ করেন
ব্যবসায়ীরা। চামড়াজাত
পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে
এর সঙ্গে যোগ
হয় রাসায়নিক ও
শ্রমিক খরচ।
গত অর্থবছর
চামড়া ও চামড়াজাত
পণ্য রপ্তানি করেই
ব্যবসায়ীরা বছরে
পান ৯ হাজার
কোটি টাকারও বেশি।
অর্থাৎ প্রায় তিন
হাজার কোটি টাকার
চামড়া কিনে ব্যবসায়ীরা
শুধু বিদেশে রপ্তানি
করেই পাচ্ছেন ৯
হাজার কোটি টাকা।
শুধু রপ্তানি মূল্যের
পরিমাণই কাঁচামালের
মূল্যের চেয়ে
প্রায় ছয় হাজার
কোটি টাকা বেশি।
আবার প্রতি ১০০
টাকার চামড়া ও
চামড়াজাত পণ্য
রপ্তানি করলে
সরকার রপ্তানিকারকদের ১৫
টাকা হারে নগদ
সহায়তা দেয়। এতে
প্রায় এক হাজার
৩৫০ কোটি টাকার
নগদ সহায়তা দিতে
হয় সরকারকে, যা
সরাসরি রপ্তানিকারকরা পেয়ে
থাকেন। এসবের পাশাপাশি
ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন
স্থানীয় বাজারে
চামড়া ও চামড়াজাত
পণ্য বিক্রির অর্থও।
দেশের ভেতরে স্থানীয়ভাবে
উৎপাদিত চামড়াজাত
যেসব পণ্য বিক্রি
হচ্ছে, সেসব চামড়ার
জোগান আসে ওই
তিন হাজার কোটি
টাকার চামড়ার মধ্য
থেকেই। সাধারণত নিম্নমানের
চামড়া বা চামড়ার
খণ্ডাংশ, পশুর
মাথা ও পায়ের
চামড়ার অংশ দিয়ে
দেশে বিক্রির জন্য
জুতা, ব্যাগ, বেল্ট,
মানিব্যাগসহ চামড়াজাত
বিভিন্ন পণ্য
উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স
অ্যাসোসিয়েশনের নেতা
এবং হাজারীবাগের ফেন্সি
লেদার এন্টারপ্রাইজের মালিক
মো. শামসুল হুদা
কালের কণ্ঠকে বলেন,
‘কোরবানির সময়
এক হাজার থেকে
দেড় হাজার কোটি
টাকার চামড়া পাওয়া
যায়, যা দেশের
মোট উৎপাদিত চামড়ার
৬০ শতাংশ। বছরের
বাকি সময়সহ সারা
বছর প্রায় আড়াই
হাজার কোটি টাকার
কাঁচা চামড়া কেনা
হয়। এসব চামড়া
রপ্তানি করে
৯ হাজার কোটি
টাকা আয় হয়
ঠিকই; কিন্তু চামড়া
কেনার খরচ ছাড়াও
আমাদের ২০ শতাংশ
প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ,
শ্রমিক ও রাসায়নিক
খরচ বাবদ বিপুল
অর্থ ব্যয় করতে
হয়। ফলে ছয়
হাজার কোটি টাকার
পুরোটাই মুনাফা
নয়। এ ছাড়া
মানসম্পন্ন চামড়ার
উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে
স্থানীয় বাজারে
চামড়াজাত পণ্য
তৈরি করা হয়।’
গতকাল সকালে
ধানমণ্ডির একটি
রেস্তোরাঁয় সংবাদ
সম্মেলনে বাংলাদেশ
ফিনিশড লেদার, লেদার
গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি
মহিউদ্দিন আহমেদ
মাহিন ঢাকায় গরুর
লবণযুক্ত চামড়ার
দাম ৫০ টাকা
ও ঢাকার বাইরে
৪০ টাকা ঘোষণা
করেন। গত বছর
ঢাকায় প্রতি বর্গফুট
গরুর চামড়া ৫০
থেকে ৫৫ টাকা
এবং ঢাকার বাইরে
৪০-৪৫ টাকায়
কিনেছেন তাঁরা।
এবার সারা
দেশে খাসির লবণযুক্ত
চামড়া বর্গফুট প্রতি
২০ টাকা ও
ছাগলের চামড়া ১৫
টাকা ধরা হয়েছে।
গত বছর খাসির
লবণযুক্ত চামড়ার
দর ছিল ২০
থেকে ২২ টাকা
এবং ছাগলের চামড়া
১৫ থেকে ১৭
টাকা। গত বছর
প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত
মহিষের চামড়ার দর
ছিল ৩৫ থেকে
৪০ টাকা। এ
বছর তা ২৫
টাকায় কেনার ঘোষণা
দিয়েছেন ট্যানারি
মালিকরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি
শাহীন আহমেদ সংবাদ
সম্মেলনে বলেন,
আন্তর্জাতিক বাজারে
চামড়ার দরপতন হয়েছে।
এ ছাড়া গতবারের
কেনা চামড়ার ৩০
শতাংশ এখনো মজুদ
রয়ে গেছে। সব
কিছু মিলিয়ে এবার
দর কিছুটা কমিয়ে
নির্ধারণ করা
হয়েছে। যুক্তি দেখিয়ে
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক
বাজারে গত এক
বছরে চামড়ার দাম
৩৫ শতাংশ কমে
গেছে। আর কোরবানির
পশুর চামড়ার দর
এবার যেটা নির্ধারণ
করা হয়েছে, তা
গতবারের চেয়ে
১০ শতাংশ কম।
আন্তর্জাতিক বাজারে
দরপতনের পাশাপাশি
দুই সপ্তাহ ধরে
লবণের উচ্চমূল্যকে অজুহাত
হিসেবে দাঁড় করিয়ে
চামড়ার দাম কমিয়ে
নির্ধারণের চেষ্টা
করে আসছিলেন ট্যানারি
মালিকরা। কিন্তু
কোরবানির পর
মাঠ পর্যায় থেকে
চামড়া কেনেন ক্ষুদ্র
ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা ওই দিনই
চামড়াগুলো জেলা
বা উপজেলা পর্যায়ে
অপেক্ষাকৃত বড়
ব্যবসায়ীদের কাছে
বিক্রি করে দেন।
ওই সব মাঝারি
মানের ব্যবসায়ীরা জেলার
আড়তদারদের কাছে
তা বিক্রি করেন।
সাধারণত ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ীর কাছ
থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরা
চামড়া কেনার পরপরই
তাতে লবণ দেওয়া
হয়। একটি বড়
গরুর চামড়া সংরক্ষণে
প্রায় আট কেজি
কাঁচা লবণ লাগে।
এগুলো মানুষের খাবার
লবণ নয়। সামান্য
পরিশোধিত এসব
লবণের প্রতি ৭৫
কেজি বস্তার দাম
এক হাজার ১০০
টাকা। অর্থাৎ প্রতি
কেজি লবণের দাম
১৪ টাকা ৬০
পয়সা হিসাবে একটি
বড় গরুর চামড়া
সংরক্ষণে খরচ
হয় ১১৭ টাকা।
ক্ষুদ্র ও
মাঝারি ব্যবসায়ীরা কোরবানিদাতার
কাছ থেকে চামড়া
কেনার সময় লবণের
মূল্য বাবদ ১১৭
টাকা হিসাব করে
আরো কম টাকায়
চামড়া কিনবেন। ফলে
কোরবানিদাতা প্রতি
বর্গফুটে ট্যানারি
মালিকদের নির্ধারিত
মূল্যের চেয়েও
অনেক কম মূল্য
পাবেন।
0 comments:
Post a Comment