Friday, November 13, 2015

ঐশীর ঘটনা - আমাদের জন্য শিক্ষনীয় ও করনীয়

  ঐশীর ঘটনা - আমাদের জন্য শিক্ষনীয় ও করনীয় 

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ ، أَوْ يُمَجِّسَانِه ». প্রতিটি শিশু (ইসলাম) ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতামাতাই তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়। [সহীহ বুখারী : ১২৯২; ইবন হিব্বান : ১২৯; বাইহাকী : ১১৯১৮]


সন্তানের জন্য পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার পর সবচে আপন  এবং শ্রদ্ধেয়-তার পিতা- মাতা। আল্লাহ নিজেও কোরআনে হাকিমে মাতা-পিতা সম্পর্কে বলেছেন-আর তোমাদের প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত-অনুগত্য করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করো; যদি তাঁদের একজন বা উভয়ই তোমাদের সামনে বার্ধক্যে উপনীত হন তবে তুমি তাঁদের প্রতি উহঃ (ঘৃণা বা দুঃখ ব্যঞ্জক) শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বলো তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। এবং তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে নম্রভাবে বাহু নত করে দাও এবং (আল্লাহ পাককে) বলো-হে আমার মালিক! তাঁরা (অর্থাৎ পিতা মাতা) শৈশবে আমাকে যেভাবে স্নেহ-যতেœ লালন-পালন করেছেন, তুমিও তাঁদের প্রতি সেভাবে সদয় হও (সুরা-বনী ইসলাঈল-২৩-২৪)

মুফাচ্ছির--কোরআনেরা পিতা-মাতার আনুগত্য বলতে এই বুঝিয়েছেন-তাঁরা যাতে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারেন সেদিকে সন্তানের সুদৃষ্টি রাখা এবং সন্তানের এমন কোনো কাজ না করা যার দ্বারা পিতা-মাতার মনে আঘাত আসে। এবং তাঁদের ইসলামসম্মত সমস্ত আদেশ-নিষেধ পালন করা। যদি তাঁরা ইসলাম বিরোধী কোনো আদেশ দেন অথবা শক্তি প্রয়োগ করেন তাহলে সন্তান পিতা-মাতার আদেশ অমান্য করে আল্লাহর বিধান মান্য করবে। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাঁদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে হবে। সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন-
যদি তাঁরা (পিতা-মাতা) তোমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য যা (শিরক) তোমার বোধগম্য নয়, তাহলে তুমি তাঁদের কথা অমান্য করো, (অর্থাৎ আমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না) আর পার্থিব জীবনে উৎকৃষ্ট পন্থায় তাঁদের সাথে সৎ সম্পর্ক বজায় রেখো। আর তুমি তাঁদের পথ অনুসরণ করো যারা (আমি এক) আমার প্রতি অবিচলভাবে আকৃষ্ট রয়েছে। (সূরা লুকমান : আয়াত ১৫)
এই আয়াত দ্বারা সহজে বুঝা যায়, পিতা-মাতা যদি ইসলাম বিরোধী আদেশ দেন তবে তা অমান্য করতে হবে কিন্তু তাঁদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করা চলবে না। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন হযরত ইব্রাহীম (.) এছাড়াও আরো বহু উদাহরণ মহাপুরুষদের জীবনীতে পাওয়া যায়। 

সন্তান আল্লাহ তাআলার দেয়া আমানত। সুতরাং প্রত্যেক  পিতা মাতার জন্য আবশ্যক হল সন্তানের ব্যাপারে যত্নবান হ্ওয়া। পিতা মাতার অসর্তকতার কারণে সন্তানের জীবন যদি সুন্দর না হয়, তাহলে এর জন্য পিতা-মাতাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।সন্তান লালন-পালনে পিতা-মাতার করণীয় প্রতিটি মানুষই বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর সন্তান কামনা করেন। অধিকাংশ দম্পতিই হন সন্তানের গর্বিত পিতা-মাতা। কিন্তু মনে রাখতে হবে শুধু সন্তান জন্ম দিয়ে পিতা-মাতা হওয়াই যথেষ্ট নয়। সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল পিতা বা মাতা। অন্যথায় দুনিয়াতে যেমন রয়েছে ভোগান্তি, আখিরাতেও রয়েছে তেমনি অশান্তি এবং অপেক্ষমান নিচ্ছিদ্র জবাবদিহিতা। কারণ, সন্তান হলো পিতা-মাতার কাছে প্রদত্ত আল্লাহর আমানত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ. الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ, وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهْوَ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ, وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ». তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল; তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ সন্তানের); সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এককথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে। [সহীহ বুখারী : ৭১৩৮; তিরমিযী : ১৭০৫] 

বলাবাহুল্য, পরিচর্যা যা করার প্রতিটি জিনিসের প্রাথমিক পর্যায়েই তা করতে হয়। শিশুকে মূলত ভালো-মন্দ উভয় চরিত্রের মিশ্রণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার পিতামাতাই তাকে ভালো-মন্দের যে কোনোটির দিকে ধাবিত করেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ ، أَوْ يُمَجِّسَانِه ». প্রতিটি শিশু (ইসলাম) ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতামাতাই তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়। [সহীহ বুখারী : ১২৯২; ইবন হিব্বান : ১২৯; বাইহাকী : ১১৯১৮]

অতএব আল্লাহর আমানত সম্পর্কে আমাদের সজাগ আরও  বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। সন্তানদের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক খোরাকের প্রতিও নজর রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তার নির্দেশ মতো সন্তান মানুষ করার তাওফীক দান করুন। ﴿رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا﴾ [الفرقان : 74] হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৭৪} আমীন।

এত গেল কুরআন হাদিসের এখন আসি আমার ব্যাক্তিগত কিছু কথায় ...............
আমরা যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি, তার ভাল খারাপ প্রভাব সমাজে পড়ছে। অনেক টাকা সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হাতে চলে আসছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় জীবন বদলে যাচ্ছে। পুরাতন মূল্যবোধগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। আমরা ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে আছি। সমাজের এই অস্থিরতা দূর করতে নতুন মূল্যবোধের প্রয়োজন। আমি জানি না, নতুন মূল্যবোধ কি হবে। প্রথমত আমি বলতে চাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভাল মানুষ তৈরি করতে পারছে না। প্রতিবছর হাজারও সার্টিফিকেটধারি চাকুরে বের হয়। সুশিক্ষিত মানুষ না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল একটি গবেষণা প্রবন্ধ কবে প্রকাশিত হয়েছিল তা বলা মুশকিল।

আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ছে। আমাদের এই মূল্যবোধগুলো ধরে রাখা সামাজিক কারণেই অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু অসম্ভব বলে মনে করি না আমি। আমাদের সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব আমাদেরই। পরিবার সন্তান সবার জন্যই ঘরের গৃহিণী আর বাবা-মায়ের ভূমিকা থাকে। মায়ের দায় একটু বেশি কারণ, প্রকৃতগতভাবেই নারী ঘরমুখো, সন্তান মা নির্ভর। তাই মায়ের সাথে সন্তানের যে সহজগতিময় একটা সম্পর্ক থাকে, তা যত্ন করতে হবে। ঐশীকে আমরা খারাপ বলছি, তাকে সমাজ পিতা-মাতার ঘাতক বলে ধিক্কার দিচ্ছে। কিন্তু ক্রমেই যখন ঐশী আদুরে নিষ্পাপ সন্তান থেকে মাদকাসক্ত খুনি হয়ে উঠছিল তখন তার মা-বাবা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা ছেলে-মেয়েদের এই পরিস্থিতি লুকিয়ে রেখে নিজেদের সন্তানের কারোই মঙ্গল করতে পারি না। সময়ের অভাব আমাকে আপনাকে যেন সন্তানদের প্রতি উদাসীন না করে, প্রত্যেক বাবা-মা তো বটেই মাকে বেশি সতর্ক হতে হবে। আপনার ঘরে ঐশীকে না দেখতে চাইলে, সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কি করে তা খোঁজ রাখুন। সন্তানের মনে প্রতিহিংসা তৈরি করবেন না, সহযোগিতার হাত বাড়ান। আমাদের সমাজ আজও ঐশীদের দায়িত্ব নেয়ার মতো প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্তভাবে গড়ে উঠেনি, তাই দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।

0 comments:

Post a Comment